পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brど)S রবীন্দ্র-রচনাবলী চিঠি লিখিতে আরম্ভ করিয়াই তোমাকে কী “পাঠ’ লিখিব। এই ভাবনা প্রথম মনে উদয় হয় । একবার ভাবিলাম লিখি “মাই ডিয়ার নাতি', কিন্তু সেটা আমার সহ্য হইল না ; তার পরে ভাবিলাম বাংলা করিয়া লিখি “আমার প্রিয় নাতি’, সেটাও বুড়োমানুষের এই খাকড়ার কলম দিয়া বাহির হইল না। খপ করিয়া লিখিয়া ফেলিলাম ‘পরমশুভাশীর্বাদরাশয়ঃ সন্তু । লিখিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাচিলাম । ভাবিলাম ছেলেপিলেরা তো আমাদিগকে প্ৰণাম করা বন্ধ করিয়াছে, তাই বলিয়া কি আমরা তাহাদিগকে আশীর্বাদ করিতে ভুলিব ! তোমাদের ভালো হউক ভাই, আমরা এই চাই ; আমাদের যা হইবার হইয়া গিয়াছে। তোমরা আমাদের প্রণাম কর আর না করি আমাদের তাহাতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, কিন্তু তোমাদের আছে । ভক্তি করিতে যাহাদের লজাবোধ হয় তাহাদের কোনোকালে মঙ্গল হয় না । বড়োর কাছে নিচু হইয়া আমরা বড়ো হইতে শিখি, মাথাটা তুলিয়া থাকিলেই যে বড়ো হই তাহা নয় । ‘পৃথিবীতে আমার চেয়ে উচু আর কিছু নাই— আমি বাবার জ্যেষ্ঠতাত— আমি দাদার দাদা এইটে যে মনে করে সে অত্যন্ত ক্ষুদ্র । তাহার হৃদয় এত ক্ষুদ্র যে সে আপনার চেয়ে বড়ো কিছুই কল্পনা করিতে পারে না । তুমি হয়তো আমাকে বলিবে, “তুমি আমার দাদামহাশয় বলিয়াই যে তুমি আমার চেয়ে বড়ো এমন কোনো কথা নাই ।” আমি তোমার চেয়ে বড়ো নাই ! তোমার পিতা আমার স্নেহে প্ৰতিপালিত হইয়াছেন, আমি তোমার চেয়ে বড়ো নাই তো কী ? আমি তোমাকে স্নেহ করিতে আমি তোমার চেয়ে বড়ো । তুমি নাহয় দু-পাচখান ইংরাজি বই আমার চেয়ে বেশি পড়িয়াছ, তাহাতে বেশি আসে যায় না । আঠারো হাজার ওয়েবস্টার ডিকশনারির উপর যদি তুমি চড়িয়া ব্যস তাহা হইলেও তোমাকে আমার হৃদয়ের নীচে দাড়াইতে হইবে । তবুও আমার হৃদয় হইতে আশীর্বাদ নামিয়া তোমার মাথায় বর্ষিত হইতে থাকিবে । পুঁথির পর্বতের উপর চড়িয়া তুমি আমাকে নিচু নজরে দেখিতে দেখিতে পারো না । যে ব্যক্তি মাথা পাতিয়া অসংকোচে মেহের আশীর্বাদ গ্রহণ করিতে পারে সে ধন্য, তাহার হৃদয় উর্বর হইয়া ফলে ফুলে শোভিত হইয়া উঠুক। আর, যে ব্যক্তি বালুকাস্তুপের মতো মাথা উচু করিয়া মেহের আশীর্বাদ উপেক্ষা করে সে তাহার শূন্যতা শুষ্কতা শ্ৰীহীনতা— তাহার মরুময় উন্নত মস্তক— লইয়া মধ্যাহ্নতেজে দগ্ধ হইতে থাকুক। যাহাই হউক ভাই, আমি তোমাকে একশো বার লিখিব ‘পরমশুভাশীর্বাদরাশয়ঃ সন্তু, তুমি আমার চিঠি পড় আর নাই পড় । তুমিও যখন আমার চিঠির উত্তর দিবে, প্ৰণামপূর্বক চিঠি আরম্ভ করিয়ো । তুমি হয়তো বলিয়া উঠিবে, “আমার যদি ভক্তি না হয় তো আমি কেন প্ৰণাম করিব ? এ-সব অসভ্য আদব-কায়দার আমি কোনো ধার ধারি না ।” তাই যদি সত্য হয় তবে কেন, ভাই, তুমি বিশ্বসুদ্ধ লোককে “মাই ডিয়ার' লেখ । আমি বুড়ো, তোমার ঠাকুরদাদা, আজ সাড়ে তিন মাস ধরিয়া কাশিয়া মরিতেছি, তুমি একবার খোজ লাইতে আস না । আর, জগতের সমস্ত লোক তোমার এমনি প্রিয় হইয়া উঠিয়াছে যে তাহাদিগকে “মাই ডিয়ার’ না লিখিয়া থাকিতে পারো না । এও কি একটা দস্তুর মাত্র নয় ? কোনোটা বা ইংরাজি দস্তুর, কোনোটা বাংলা দস্তুর । কিন্তু সেই যদি দস্তুর-মতোই চলিতে হইল। তবে বাঙালির পক্ষে বাংলা দস্তুরই ভালো । তুমি বলিতে পারে, “বাংলাই কি ইংরাজিই কি, কোনো দস্তুর, কোনো আদব-কায়দা মানিতে চাহি না । আমি হৃদয়ের অনুসরণ করিয়া চলিব।’ তাই যদি তোমার মত হয়, তুমি সুন্দরবনে গিয়া বাস করো, মনুষ্যসমাজে থাকা তোমার কর্ম নয়। সকল মানুষেরই কতকগুলি কর্তব্য আছে, সেই কর্তব্যশৃঙ্খলে সমাজ জড়িত। আমার কর্তব্য আমি না করিলে, তোমার কর্তব্য তুমি ভালোরূপে করিতে পারো না । দাদামহাশয়ের কতকগুলি কর্তব্য আছে, নাতির কতকগুলি কর্তব্য আছে। তুমি তাহা আমি ভালোরূপে সম্পন্ন করিতে পারি। আর, তুমি যদি বল “আমার মনে যখন ভক্তির উদয় হইতেছে না। তখন আমি কেন দাদামহাশয়ের কথা শুনিব, তাহা হইলে যে কেবল তোমার কর্তব্যই অসম্পূর্ণ রহিল তাহা নহে, তাহা হইলে আমার কর্তব্যেরও ব্যাঘাত হয়। তোমার দৃষ্টান্তে তোমার