পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brዒ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী করিতে আসি নাই। আমাদের লজ্জা একদিন দূর হইবে । ইহা আমরা হৃদয়ের ভিতর হইতে অনুভব করিতেছি । আমাদের আশ্বাসের কারণও আছে । আমাদের বাঙালির মধ্য হইতেই তো চৈতন্য জন্মিয়াছিলেন । তিনি তো বিঘাকাঠার মধ্যেই বাস করিতেন না, তিনি তো সমস্ত মানবকে আপনার করিয়াছিলেন । তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন। তখন তো বাংলা পৃথিবীর এক প্রান্তভাগে ছিল, তখন তো সাম্য ভ্রাতৃভাব প্রভৃতি কথাগুলোর সৃষ্টি হয় নাই, সকলেই আপনি-আপনআহিব্রুক তপণ ও চণ্ডীমণ্ডপটি লইয়া ছিল— তখন এমন কথা কী করিয়া বাহির হইল ‘মার খেয়েছি, নাহয় আরও খাব ৷ তাই বলে কি প্ৰেম দিব না ? আয় ।” এ কথা ব্যাপ্ত হইল কী করিয়া ? সকলের মুখ দিয়া বাহির হইল কী করিয়া ? আপনি-আপিন বঁাশবাগানের পার্শ্বস্থ ভদ্রাসনবাটীর মনসাসিজের বেড়া ডিঙাইয়া পৃথিবীর মাঝখানে আসিতে কে আহবান করিল এবং সে আহবানে সকলে সাড়া দিল কী করিয়া ? একদিন তো বাংলাদেশে ইহাও সম্ভব হইয়াছিল । একজন বাঙালি আসিয়া একদিন বাংলাদেশকে তো পথে বাহির করিয়াছিল । একজন বাঙালি তো একদিন সমস্ত পৃথিবীকে পাগল করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল এবং বাঙালিরা সেই ষড়যন্ত্রে তো যোগ দিয়াছিল । বাংলার সে এক গৌরবের দিন । তখন বাংলা স্বাধীনই থাকুক। আর অধীনই থাকুক, মুসলমান নবাবের হাতেই থাকুক আর স্বদেশীয় রাজার হাতেই থাকুক, তাহার পক্ষে সে একই কথা । সে আপন তেজে আপনি তেজস্বী হইয়া উঠিয়াছিল । আসল কথা, বাংলায় সেই একদিন সমস্ত একাকার হইবার জো হইয়াছিল । তাই কতকগুলো লোক খেপিয়া চৈতন্যকে কলসীর কােনা ষ্টুড়িয়া মারিয়াছিল। কিন্তু কিছুই করিতে পারিল না । কলসীর কানা ভাসিয়া গেল । দেখিতে দেখিতে এমনি একাকার হইল যে, জাতি রহিল না, কুল রহিল না, হিন্দু-মুসলমানেও প্রভেদ রহিল না । তখন তো আর্যকুলতিলকেরা জাতিভেদ লইয়া তর্ক তুলে নাই । আমি তো বলি তর্ক করিলেই তর্ক উঠে । বৃহৎ ভাব যখন অগ্রসর হইতে থাকে তখন তর্কবিতর্ক খুঁটিনাটি সমস্তই অচিরাৎ আপনি-আপন গর্তের মধ্যে সুড়সুড়ি করিয়া প্রবেশ করে । কারণ, মরার বাড়া আর গাল নাই। বৃহৎ ভাব আসিয়া বলে, সুবিধা-অসুবিধার কথা হইতেছে না, আমার জন্য সকলকে মরিতে হইবে । লোকেও তাহার আদেশ শুনিয়া মরিতে বসে । মরিবার সময় খুঁটিনাটি লইয়া তর্ক করে কে বলে ! চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলাদেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন এককণ্ঠবিহারী বৈঠকি সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল ? তখন সহস্ৰ হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোল সহস্ৰ কণ্ঠ উচ্ছসিত করিয়া নূতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগ রাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্ৰ জনকে বরণ করিল। বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নূতন কীর্তন উঠিল। যেমন ভাব তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর— অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্ৰন্দনধ্বনি । বিজন কক্ষে বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া একটিমাত্র বিরাহিণীর বৈঠকি কান্না নয়, প্রেমে আকুল হইয়া নীলাকাশের তলে দাড়াইয়া সমস্ত বিশ্বজগতের ক্ৰন্দনধ্বনি । তাই আশা হইতেছে- আর একদিন হয়তো আমরা একই মত্ততায় পাগল হইয়া সহসা একজাতি হইয়া উঠিতে পারিব, বৈঠকখানার আসবাব ছাড়িয়া সকলে মিলিয়া রাজপথে বাহির হইতে পারিব, বৈঠকি ধ্রুপদ খেয়াল ছাড়িয়া রাজপখী কীর্তন গাহিতে পারিব । মনে হইতেছে এখনি বঙ্গদেশের প্রাণের মধ্যে একটি বৃহৎ কথা প্রবেশ করিয়াছে, একটি আশ্বাসের গান ধ্বনিত হইতেছে, তাই সমস্ত দেশটা মাঝে মাঝে টলমল করিয়া উঠিতেছে। এ যখন জাগিয়া উঠিবে তখন আজিকার দিনের এই-সকল সংবাদপত্রের মেকি সংগ্রাম, শতসহস্ৰ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তর্কবিতর্ক ঝগড়াঝাটি সমস্ত চুলায় যাইবেআজিকার দিনের বড়ো বড়ো ছোটোলোকদিগের নখে-আঁকা গণ্ডিগুলি কোথায় মিলাইয়া যাইবে ! সেই আর-একদিন বাংলা একাকার হইবে ।