পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চিঠিপত্র brዔ (፩ প্রকৃত স্বাধীনতা ভাবের স্বাধীনতা । বৃহৎ ভাবের দাস হইলেই আমরা স্বাধীনতার প্রকৃত সুখ ও গৌরব অনুভব করিতে পারি। তখন কেই বা রাজা, কেই বা মন্ত্রী ! তখন একটা উচু সিংহাসনমাত্র গড়িয়া আমাদের চেয়ে কেহ উচু হইতে পারে না । সেই গৌরব হৃদয়ের মধ্যে অনভব করিতে পারিলেই আমাদের সহস্ৰ বৎসরের অপমান দূর হইয়া যাইবে, আমরা সকল বিষয়ে স্বাধীন হইবার যোগ্য হইব । আমাদের সাহিত্য যদি পৃথিবীর সাহিত্য হয়, আমাদের কথা যদি পৃথিবীর কাজে লাগে, এবং সে সূত্রেও যদি বাংলার অধিবাসীরা পৃথিবীর অধিবাসী হইতে পারে, তাহা হইলেও আমাদের মধ্যে গৌরব জন্মিবে— হীনতা ধুলার মতো আমরা গা হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতে পারিন । কেবলমাত্র বন্দুক ষ্টুড়িতে পারিলেই যে আমরা বড়োলোক হইব। তাহা নহে, পৃথিবীর কাজ করিতে পারিলে তবে আমরা বড়োলোক হইব । আমার তো আশা হইতেছে আমাদের মধ্যে এমন-সকল বড়োলোক জন্মিবেন র্যাহারা বঙ্গদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রের শামিল করিবেন ও এইরূপে পৃথিবীর সীমানা বাড়াইয়া দিবেন। তুমি নাকি বড়ো চিঠি পড় না, তাই ভয় হইতেছে পাছে এই চিঠি ফেরত দিয়া ইহার সংক্ষেপ মর্ম লিখিয়া পাঠাইতে অনুরোধ কর । কিন্তু তুমি পড় আর নাই পড় আমি লিখিয়া আনন্দলাভ করিলাম । এ যেন আমিই আমাকে চিঠি লিখিলাম, এবং পড়িয়া সম্পূর্ণ পরিতোষ প্রাপ্ত হইলাম । সেবক শ্ৰীনবীনকিশোর শর্মণঃ Գ চিরঞ্জাবেযু ভায়া আমাদের সেকালে পোস্টাপিসের বাহুল্য ছিল না— জরুরি কাজের চিঠি ছাড়া অন্য কোনোপ্রকার চিঠি হাতে আসিত না, এইজন্য সংক্ষেপ-চিঠি পড়াই আমাদের অভ্যাস । তা ছাড়া বুড়ামানুষ— প্রত্যেক অক্ষর বানান করিয়া করিয়া পড়িতে হয়— বড়ো চিঠি পড়িতে ডরাই সে কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু তোমার চিঠি পড়িয়া দীর্ঘ পত্র পড়ার দুঃখ আমার সমস্ত দূর হইল । তুমি যে হৃদয়পূর্ণ চিঠি লিখিয়াছ তাহার সমালোচনা করিতে বসিতে আমার মন সরিতেছে না । কিন্তু বুড়ামানুষের কাজই সমালোচনা করা । যৌবনের সহজ চক্ষুতে প্রকৃতির সৌন্দর্যগুলিই দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু চশমার ভিতর দিয়া কেবল অনেকগুলা খুঁত এবং খুঁটিনাটি চোখে পড়ে । বিদেশে গিয়া যে বাঙালি জাতির উন্নতি-আশা তোমার মনে উচ্ছসিত হইয়াছে, তাহার গুটিকতক কারণ আছে। প্রধান কারণ- এখানে তোমার অজীর্ণ রোগ ছিল, সেখানে তোমার খাদ্য জীৰ্ণ হইতেছে এবং সেইসঙ্গে ধরিয়া লইতেছ। যে বাঙালি মাত্রেরই পেটে অন্ন পরিপাক পাইতেছে- এরূপ অবস্থায় কাহার না। আশার সঞ্চার হয় ! কিন্তু আমি অম্লশূলপীড়ায় কাতর বাঙালিসন্তান— তোমার চিঠিটা আমার কাছে আগাগোড়াই কাহিনী বলিয়া ঠেকিতেছে। পেটে আহার জীর্ণ হওয়া এবং না । হওয়ার উপর পৃথিবীর কত সুখদুঃখ মঙ্গল-অমঙ্গল নির্ভর করে তাহা কেহ ভাবিয়া দেখে না । পাকযন্ত্রের উপর যে উন্নতির ভিত্তি স্থাপিত হয় নাই সে উন্নতি ক'দিন টিকিতে পারে ? জঠরানালের প্রখর প্রভাবেই মনুষ্যজাতিকে অগ্রসর করিয়া দেয় । যে জাতির ক্ষুধা কম। সে জাতি থাকিলেও হয় গেলেও হয় ; তাহার দ্বারা কোনো কাজ হইবে না । যে জাতি আহার করে, অথচ হজম করে না, সে । জাতি কখনোই সদগতি প্ৰাপ্ত হইতে পারে না । । বাঙালি জাতির অন্নরোগ হইল বলিয়া বাঙালি কেরানিগিরি ছড়িতে পারিল না । তাহার সাহস হয় না, আশা হয় না, উদ্যম হয় না। এজন্য বেচারাকে দোষ দেওয়া যায় না । আমাদের শরীর অপটু, বুদ্ধি