পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

www রবীন্দ্র-রচনাবলী বুঝিয়াছি তুমি কী বলিতে চাও । স্বভাবত আমাদের মহাপ্ৰাণী তাহার অতিগোপন নির্মাণশালায় বসিয়া এক অপূর্ব নিয়মে আমাদের জীবন গড়েন, কিন্তু ডায়ারি লিখিতে গেলে দুই ব্যক্তির উপর জীবন গড়িবার ভার দেওয়া হয় । কতকটা জীবন অনুসারে ডায়ারি হয়, কতকটা ডায়ারি অনুসারে জীবন হয় । স্রোতস্বিনী এমনি সহিষ্ণুভাবে নীরবে সমনোযোগে সকল কথা শুনিয়া যায় যে, মনে হয় যেন বহু যত্নে সে আমার কথাটা বুঝিবার চেষ্টা করিতেছে- কিন্তু হঠাৎ আবিষ্কার করা যায় যে, বহুপূর্বেই সে আমার কথাটা ঠিক বুঝিয়া লইয়াছে। আমি কহিলাম— সেই বটে । দীপ্তি কহিল— তাহাতে ক্ষতি কী ? আমি কহিলাম— যে ভুক্তভোগী সেই জানে। যে লোক সাহিত্যব্যবসায়ী সে আমার কথা বুঝিবে । সাহিত্যব্যবসায়ীকে নিজের অন্তরের মধ্যে হইতে নানা ভাব এবং নানা চরিত্র বাহির করিতে হয়। যেমন ভালো মালী ফর্মাশ-অনুসারে নানারূপ সংঘটন এবং বিশেষরূপ চাষের দ্বারা একজাতীয় ফুল হইতে নানাপ্রকার ফুল বাহির করে, কোনোটার বা পাতা বড়ো, কোনোটার বা রঙ বিচিত্র, কোনোটার বা গন্ধ সুন্দর, কোনোটার বা ফল সুমিষ্ট, তেমনি সাহিত্যব্যবসায়ী আপনার একটি মন হইতে নানাবিধ ফলন বাহির করে । মনের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ভাবের উপর কল্পনার উত্তাপ প্রয়োগ করিয়া তাহাদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্র সম্পূৰ্ণ আকারে প্রকাশ করে। যে-সকল ভাব, যে-সকল স্মৃতি, মনোবৃত্তির যে-সকল উচ্ছাস সাধারণ লোকের মনে আপনি আপনি যথানিদিষ্ট কাজ করিয়া যথাকলে ঝরিয়া পড়ে, অথবা রূপান্তরিত হইয়া যায়— সাহিত্যব্যবসায়ী সেগুলিকে ভিন্ন করিয়া লইয়া তাহাদিগকে স্থায়ীভাবে রূপবান করিয়া তোলে। যখনি তাহাদিগকে ভালোরূপে মূর্তিমান করিয়া প্রকাশ করে, তখনি তাহারা অমর হইয়া উঠে । এমনি করিয়া ক্রমশ সাহিত্যব্যবসায়ীর মনে এক দল স্ব-স্ব-প্রধান লোকের পল্লী বসিয়া যায় । তাহার জীবনের একটা ঐক্য থাকে না । সে দেখিতে দেখিতে একেবারে শতধা হইয়া পড়ে। তাহার চিরজীবনপ্রাপ্ত ক্ষুধিত মনোভাবের দলগুলি বিশ্বজগতের সর্বত্র আপনি হস্ত প্রসারণ করিতে থাকে। সকল বিষয়েই তাঁহাদের কৌতুহল। বিশ্বরহস্য তাহাদিগকে দশ দিকে ভুলইয়া লইয়া যায়। সৌন্দর্য তাহাদিগকে বাঁশি বাজাইয়া বেদনপাশে বদ্ধ করে । দুঃখকেও তাহারা ক্রীড়ার সঙ্গী করে, মৃত্যুকেও তাহারা পরখ করিয়া দেখিতে চায়। নবীকৌতুহলী শিশুদের মতো সকল জিনিসই তাহারা স্পর্শ করে, ভ্ৰাণ করে, আস্বাদন করে, কোনো শাসন মানিতে চাহে না । একটা দীপে একেবারে অনেকগুলা পলিতা জ্বালাইয়া দিয়া সমস্ত জীবনটা হুহু শব্দে দগ্ধ করিয়া ফেলা হয়। একটা প্রকৃতির মধ্যে এতগুলা জীবন্ত বিকাশ বিষম বিরোধ-বিশৃঙ্খলার কারণ হইয়া দাঁড়ায় । স্রোতস্বিনী ঈষৎ স্নানভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন- আপনাকে এইরূপ বিচিত্ৰ স্বতন্ত্র ভাবে ব্যক্তি করিয়া তাহার কি কোনো সুখ নাই ? আমি কহিলাম— সৃজনের একটা বিপুল আনন্দ আছে। কিন্তু কোনো মানুষ তো সমস্ত সময় সৃজনে ব্যাপৃত থাকিতে পারে না— তাহার শক্তির সীমা আছে, এবং সংসারে লিপ্ত থাকিয় তাহাকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেও হয় । এই জীবনযাত্রায় তাহার বড়ো অসুবিধা । মনটির উপর অবিশ্রাম কল্পনার তা দিয়া সে এমনি করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহার গায়ে কিছুই সয় না। সাত-ফুটা-ওয়ালা বঁাশি বাদ্যযন্ত্রের হিসাবে ভালো, ফুৎকারমাত্রে বাজিয়া ওঠে ; কিন্তু ছিদ্রহীন পাকা বঁাশের লাঠি সংসারপথের পক্ষে ভালো, তাহার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায়। সমীর কহিল— দুৰ্ভাগ্যক্রমে বংশখণ্ডের মতো মানুষের কার্যবিভাগ নাই— মানুষ-বাঁশিকে বাজিবার সময় বঁাশি হইতে হইবে, আবার পথ চলিবার সময় লাঠি না হইলে চলিবে না । কিন্তু ভাই, তোমাদের তো অবস্থা ভালো, তোমরা কেহ বা বঁশি, কেহ বা লাঠি ; আর আমি যে কেবলমাত্ৰ ফুৎকার । আমার মধ্যে সংগীতের সমস্ত আভ্যন্তরিক উপকরণই আছে, কেবল যে-একটা বাহ্য আকারের মধ্য দিয়া তাহাকে বিশেষ রাগিণীরূপে ধ্বনিত করিয়া তোলা যায়, সেই যন্ত্রটা নাই ।