পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br@Wり রবীন্দ্র-রচনাবলী ক্ষিতি কহিলেন- তুমি বঙ্কিমবাবুর যে কয়েকখানি উপন্যাসের উল্লেখ করিয়াছ সকলগুলিই মানসপ্রধান, কার্যপ্রধান নহে। মানসজগতে স্ত্রীলোকের প্রভাব অধিক, কার্যজগতে পুরুষের প্রভুত্ব । যেখানে কেবলমাত্র হৃদয়বৃত্তির কথা সেখানে পুরুষ স্ত্রীলোকের সহিত পারিয়া উঠিবে কেন ? কার্যক্ষেত্রেই তাহার চরিত্রের যথার্থ বিকাশ হয় । দীপ্তি আর থাকিতে পারিল না- গ্ৰন্থ ফেলিয়া এবং ঔদাসীন্যের ভান পরিহার করিয়া বলিয়া উঠিল— কেন ? দুৰ্গেশনন্দিনীতে বিমলার চরিত্র কি কার্যেই বিকশিত হয় নাই ? এমন নৈপুণ্য, এমন তৎপরতা, এমন অধ্যবসায়, উক্ত উপন্যাসের কয়জন নায়ক দেখাইতে পারিয়াছে ? আনন্দমঠ তো কার্যপ্ৰধান উপন্যাস। সত্যানন্দ জীবানন্দ ভবানন্দ প্রভৃতি সন্তানসম্প্রদায় তাহাতে কাজ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহা কবির বর্ণনামাত্র, যদি কাহারও চরিত্রের মধ্যে যথার্থ কার্যকারিতা পরিস্ফুট হইয়া থাকে তাহা শান্তির। দেবীচৌধুরানীতে কে কর্তৃত্বপদ লইয়াছে ? রমণী । কিন্তু সে কি অন্তঃপুরের কর্তৃত্ব ? নহে। সমীর কহিলেন- ভাই ক্ষিতি, তৰ্কশাস্ত্রে সরলরেখার দ্বারা সমস্ত জিনিসকে পরিপাটিররূপে শ্রেণীবিভক্ত করা যায় না । শতরঞ্চিফলকেই ঠিক লাল কালো রঙের সমান ছক কাটিয়া ঘর আঁকিয়া দেওয়া যায়, কারণ, তাহা নিজীব কাষ্ঠমূর্তির রঙ্গভূমি মাত্র ; কিন্তু মনুষ্যচরিত্র বড়ো সিধা জিনিস নহে। তুমি যুক্তিবলে ভাবপ্রধান কর্মপ্ৰধান প্রভৃতি তাহার যেমনই অকাট্য সীমা নির্ণয় করিয়া দেও-না কেন, বিপুল সংসারের বিচিত্ৰ কাৰ্যক্ষেত্রে সমস্তই উলট-পালট হইয়া যায়। সমাজের লীেহকটাহের নিম্নে যদি জীবনের অগ্নি না জ্বলিত, তবে মনুষ্যের শ্রেণীবিভাগ ঠিক সমান অটলভাবে থাকিত । কিন্তু জীবনশিখা যখন প্ৰদীপ্ত হইয়া উঠে, তখন টগবগা করিয়া সমস্ত মানবচরিত্র ফুটিতে থাকে, তখন নব নব বিস্ময়জনক বৈচিত্র্যের আর সীমা থাকে না । সাহিত্য সেই পরিবর্তমান মানবজগতের চঞ্চল প্রতিবিম্ব । তাহাকে সমালোচনাশাস্ত্রের বিশেষণ দিয়া বাধিবার চেষ্টা মিথ্যা । হৃদয়বৃত্তিতে স্ত্রীলোকই শ্ৰেষ্ঠ এমন কেহ লিখিয়া পড়িয়া দিতে পারে না । ওথেলো তো মানসপ্রধান নাটক, কিন্তু তাহাতে নায়কের হৃদয়াবেগের প্রবলতা কী প্ৰচণ্ড ! কিং লিয়ারে হৃদয়ের ঝটিকা কী ভয়ংকর ! ব্যোম সহসা অধীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন- আহা, তোমরা বৃথা তর্ক করিতেছ। যদি গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখ, তবে দেখিবে কাৰ্যই স্ত্রীলোকের । কার্যক্ষেত্র ব্যতীত স্ত্রীলোকের অন্যত্র স্থান নাই । যথার্থ পুরুষ যোগী, উদাসীন, নির্জনবাসী। ক্যালডিয়ার মরুক্ষেত্রের মধ্যে পড়িয়া পড়িয়া মেষপাল পুরুষ যখন একাকী উর্ধনেত্ৰে নিশীথগগনের গ্ৰহতারকার গতিবিধি নির্ণয় করিত, তখন সে কী সুখ পাইত ! কোন নারী এমন অকাজে কালক্ষেপ করিতে পারে ? যে জ্ঞান কোনো কার্যে লাগিবে না কোন নারী তাহার জন্য জীবন ব্যয় করে ? যে ধ্যান কেবলমাত্র সংসারানিমুক্ত আত্মার বিশুদ্ধ আনন্দজনক, কোন রমণীর কাছে তাহার মূল্য আছে ? ক্ষিতির কথামত পুরুষ যদি যথার্থ কার্যশীল হইত, তবে মনুষ্যসমাজের এমন উন্নতি হইত না— তবে একটি নূতন তত্ত্ব একটি নুতন ভাব বাহির হইত না । নির্জনের মধ্যে, অবসরের মধ্যে জ্ঞানের প্রকাশ, ভাবের আবির্ভাব । যথার্থ পুরুষ সর্বদাই সেই নির্লিপ্ত নির্জনতার মধ্যে থাকে । কার্যবীর নেপোলিয়ানও কখনোই আপনার কার্যের মধ্যে সংলিপ্ত হইয়া থাকিতেন না ; তিনি যখন যেখানেই থাকুন। একটা মহানির্জনে আপন ভাবাকাশের দ্বারা বেষ্টিত হইয়া থাকিতেন- তিনি সর্বদাই আপনার একটা মস্ত আইডিয়ার দ্বারা পরিরক্ষিত হইয়া তুমুল কাৰ্যক্ষেত্রের মাঝখানেও বিজনবাস যাপন করিতেন। ভীষ্ম তো কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের একজন নায়ক কিন্তু সেই ভীষণ জনসংঘাতের মধ্যেও তাহার মতো একক প্ৰাণী আর কে ছিল ? তিনি কি কাজ করিতেছিলেন, না, ধ্যান করিতেছিলেন ? স্ত্রীলোকই যথার্থ কাজ করে । তাহার কাজের মাঝখানে কোনো ব্যবধান নাই । সে একেবারে কাজের মধ্যে লিপ্ত, জড়িত । সেই যথার্থ লোকালয়ে বাস করে, সংসার রক্ষা করে । স্ত্রীলোকই যথার্থ সম্পূর্ণরূপে সঙ্গদান করিতে পারে, তাহার যেন অব্যবহিত স্পর্শ পাওয়া যায়, সে স্বতন্ত্ৰ হইয়া থাকে না । দীপ্তি কহিল- তোমার সমস্ত সৃষ্টিছাড়া কথা- কিছুই বুঝিবার জো নাই। মেয়েরা যে কাজ করিতে পারে না। এ কথা আমি বলি না, তোমরা তাহদের কাজ করিতে দাও কই ।