পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত brss কেবলমাত্ৰ প্ৰভু নহেন, তিনি দেবতা । আমরা যে দেবতা নহি, তৃণ ও মৃত্তিকার পুত্তলিকামাত্র, সে কথা আমাদের উপাসকদের নিকট প্রকাশ করিবার প্রয়োজন কী ভাই ? ঐ-যে আমাদের মুগ্ধ বিশ্বস্ত ভক্তটি আপন হৃদয়কুঞ্জের সমুদয় বিকশিত সুন্দর পুষ্পগুলি সোনার থালে সাজাইয়া আমাদের চরণতলে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে, ও কোথায় ফিরাইয়া দিব ? আমাদিগকে দেবীসিংহাসনে বসাইয়া ঐ-যে চিরব্রতধারিণী সেবিকাটি আপন নিভৃত নিত্য প্রেমের নির্নিমেষ সন্ধ্যাদীপটি লইয়া আমাদের এই গৌরবহীন মুখের চতুর্দিকে অনন্ত অতৃপ্তিভরে শতসহস্ৰ বার প্রদক্ষিণ করাইয়া আরতি করিতেছে, উহার কাছে যদি খুব উচ্চ হইয়া না বসিয়া রহিলাম, নীরবে পূজা না গ্ৰহণ করিলাম, তবে উহাদেরই বা কোথায় সুখ আর আমাদেরই বা কোথায় সম্মান ! যখন ছোটাে ছিল তখন মাটির পুতুল লইয়া এমনিভাবে খেলা করিত যেন তাহার প্রাণ আছে, যখন বড়ো হইল তখন মানুষ পুতুল লইয়া এমনিভাবে পূজা করিতে লাগিল যেন তাহার দেবত্ব আছে— তখন যদি কেহ তাহার খেলার পুতুল ভাঙিয়া দিত তবে কি বালিকা কঁাদিত না ? এখন যদি কেহ ইহার পূজার পুতুল ভাঙিয়া দেয়। তবে কি রমণী ব্যথিত হয় না ? যেখানে মনুষ্যত্বের যথার্থ গৌরব আছে সেখানে মনুষ্যত্ব বিনা ছদ্মবেশে সম্মান আকর্ষণ করিতে পারে, যেখানে মনুষ্যত্বের অভাব সেখানে দেবত্বের আয়োজন করিতে হয়। পৃথিবীতে কোথাও পারে ? কিন্তু আমরা যে এক-একটি দেবতা, সেইজন্য এমন সুন্দর সুকুমার হৃদয়গুলি লইয়া অসংকোচে আপনার পঙ্কিল চরণের পাদপীঠ নির্মাণ করিতে পারিয়াছি । দীপ্তি কহিলেন— যাহার যথার্থ মনুষ্যত্ব আছে, সে মানুষ হইয়া দেবতার পূজা গ্ৰহণ করিতে লজ্জা অনুভব করে এবং যদি পূজা পায় তবে আপনাকে সেই পূজার যোগ্য করিতে চেষ্টা করে । কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, পুরুষসম্প্রদায় আপন দেবত্ব লইয়া নির্লজ্জভাবে আস্ফালন করে । যাহার যোগ্যতা যত অল্প তাহার আড়ম্বর তত বেশি। আজকাল স্ত্রীদিগকে পতিমাহাত্ম্য পতিপূজা শিখাইবার জন্য পুরুষগণ কায়মনোবাক্যে লাগিয়াছেন। আজকাল নৈবেদ্যের পরিমাণ কিঞ্চিৎ কমিয়া আসিতেছে বলিয়া তঁহাদের আশঙ্কা জন্মিতেছে। কিন্তু পত্নী দিগকে পূজা করিতে শিখানো অপেক্ষা পতিদিগকে দেবতা হইতে শিখাইলে কাজে লাগিতা। পতিদেবপূজা হ্রাস হইতেছে বলিয়া র্যাহারা আধুনিক স্ত্রীলোকদিগকে পরিহাস করেন, তাহাদের যদি লেশমাত্র রসবােধ থাকিত তবে সে বিদ্রুপ ফিরিয়া আসিয়া তঁহাদের নিজেকে বিদ্ধ করিত। হায় হায়, বাঙালির মেয়ে পূর্বজন্মে কত পুণ্যই করিয়াছিল তাই এমন দেবলোকে আসিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে!! কী বা দেবতার শ্ৰী ! কী বা দেবতার মাহাত্ম্য! স্রোতস্বিনীর পক্ষে ক্রমে অসহ্য হইয়া আসিল । তিনি মাথা নাডিয়া গভীর ভাবে বলিলেনতোমরা উত্তরোত্তর সুর এমনি নিখাদে চড়াইতেছ যে, আমাদের স্তবগানের মধ্যে যে মাধুর্যটুকু ছিল তাহা ক্রমেই চলিয়া যাইতেছে । এ কথা যদি বা সত্য হয় যে আমরা তোমাদের যতটা বাড়াই তোমরা তাহার যোগ্য নহ, তোমরাও কি আমাদিগকে অযথারূপে বাড়াইয়া তুলিতেছ না ? তোমরা যদি দেবতা না হও, আমরাও দেবী নহি । আমরা যদি উভয়েই আপসের দেবদেবী হই, তবে আর ঝগড়া করিবার প্রয়োজন কী ? তা ছাড়া আমাদের তো সকল গুণ নাই— হৃদয়মাহান্ত্র্যে যদি আমরা শ্রেষ্ঠ হই, মনোমােহাস্থ্যে তো তোমরা বড়ো । আমি কহিলাম- মধুর কণ্ঠস্বরে এই স্নিগ্ধ কথাগুলি বলিয়া তুমি বড়ো ভালো করিলে, নতুবা দীপ্তির বাক্যবাণবর্ষণের পর সত্য কথা বলা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিত। দেবী, তোমরা কেবল কবিতার মধ্যে দেবী, মন্দিরের মধ্যে আমরা দেবতা । দেবতার ভোগ যাহা-কিছু সে আমাদের, আর তোমাদের গ জন্য কেবল মনুসংহিতা হইতে দুইখানি কিংবা আড়াইখানি মাত্র মন্ত্র আছে। তোমরা আমাদের এমনি দেবতা যে, তোমরা যে সুখস্বাস্থ্যসম্পদের অধিকারী এ কথা মুখে উচ্চারণ করিলে হাস্যাস্পদ হইতে হয়। সমগ্ৰ পৃথিবী আমাদের, অবশিষ্ট ভাগ তোমাদের ; আহারের বেলা আমরা, উচ্ছিষ্ট্রের বেলা তোমরা। প্রকৃতির শোভা, মুক্ত বায়ু, স্বাস্থ্যকর ভ্ৰমণ আমাদের ; এবং দুর্লভ মানবজন্ম ধারণ করিয়া কেবল গৃহের কোণ, রোগের শয্যা এবং বাতায়নের প্রান্ত তোমাদের। আমরা দেবতা হইয়া সমস্ত