পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SOO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পদসেবা পাই এবং তোমরা দেবী হইয়া সমস্ত পদপীড়ন সহ্য কর— প্রণিধান করিয়া দেখিলে এ দুই দেবত্বের মধ্যে প্ৰভেদ লক্ষিত হইবে । একটা কথা মনে রাখিতে হইবে, বঙ্গদেশে পুরুষের কোনো কাজ নাই। এ দেশে গাৰ্হস্থ্য ছাড়া আর-কিছু নাই, সেই গৃহগঠন এবং গৃহবিচ্ছেদ স্ত্রীলোকেই করিয়া থাকে । আমাদের দেশে ভালোমন্দ সমস্ত শক্তি স্ত্রীলোকের হাতে ; আমাদের রমণীরা সেই শক্তি চিরকাল চালনা করিয়া আসিয়াছে। একটি ক্ষুদ্র ছিপছিপে তকতকে স্টিমনীেকা যেমন বৃহৎ বোঝাই-ভরা গাধাবোঁটটাকে স্রোতের অনুকূলে ও প্রতিকূলে টানিয়া লইয়া চলে, তেমনি আমাদের দেশীয় গৃহিণী, লোকলৌকিকতা-আত্মীয়কুটুম্বিতাপরিপূর্ণ বৃহৎ সংসার এবং স্বামী-নামক একটি চলৎশক্তিরহিত অনাবশ্যক বোঝা পশ্চাতে টানিয়া লইয়া ব্যাপৃত থাকিয়া নারীদের হইতে স্বতন্ত্র একটি প্রকৃতি গঠিত করিয়া তোলে। আমাদের দেশে পুরুষেরা গৃহপালিত, মাতৃ ললিত, পত্নীচালিত । কোনো বৃহৎ ভাব, বৃহৎ কার্য, বৃহৎ ক্ষেত্রের মধ্যে তাঁহাদের জীবনের বিকাশ হয় নাই ; অথচ অধীনতার পীড়ন, দাসত্বের হীনতা-দুর্বলতার লাঞ্ছনা। তাহাদিগকে নতশিরো সহ্য করিতে হইয়াছে । তাহাদিগকে পুরুষের কোনো কর্তব্য করিতে হয় নাই এবং কাপুরুষের সমস্ত অপমান বহিতে হইয়াছে। সৌভাগ্যক্রমে স্ত্রীলোককে কখনো বাহিরে গিয়া কর্তব্য খুঁজিতে হয় না, তরুশাখায় ফলপুষ্পের মতাে কর্তব্য তাহার হাতে আপনি আসিয়া উপস্থিত হয়। সে যখনই ভালোবাসিতে আরম্ভ করে তখনই তাহার কর্তব্য আরম্ভ হয় । তখনই তাহার চিন্তা, বিবেচনা, যুক্তি, কার্য, তাহার সমস্ত চিত্তবৃত্তি সজাগ হইয়া উঠে- তাহার সমস্ত চরিত্র উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতে থাকে । বাহিরের কোনো রাষ্ট্রবিপ্লব তাহার কার্যের ব্যাঘাত করে না, তাহার গৌরবের হ্রাস করে না, জাতীয় অধীনতার মধ্যেও তাহার তেজ রক্ষিত হয় । স্রোতস্বিনীর দিকে ফিরিয়া কহিলাম— আজি আমরা একটি নূতন শিক্ষা এবং বিদেশী ইতিহাস হইতে পুরুষকারের নূতন আদর্শ প্রাপ্ত হইয়া বাহিরের কর্মক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হইতে চেষ্টা করিতেছি । কিন্তু ভিজা কাষ্ঠ জ্বলে না, মরিচা-ধরা চাকা চলে না ; যত জ্বলে তাহার চেয়ে ধোওয়া বেশি হয়, যত চলে তাহার চেয়ে শব্দ বেশি করে । আমরা চিরদিন অকৰ্মণ্য ভাবে কেবল দলাদলি তোমরা যত সহজে যত শীঘ্ৰ গ্ৰহণ করিতে পারো, আপনার আয়ত্ত করিতে পারো, তাহাকে আপনার জীবনের মধ্যে প্রবাহিত করিতে পারো, আমরা তেমন পারি না । স্রোতস্বিনী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তার পর ধীরে ধীরে কহিলেন- যদি বুঝিতে পারিতাম আমাদের কিছু করিবার আছে এবং কী উপায়ে কী কর্তব্যসাধন করা যায়, তাহা হইলে আর কিছু না হােক চেষ্টা করিতে পারিতাম । আমি কহিলাম- আর তো কিছুই করিতে হইবে না । যেমন আছ তেমনি থাকে । লোকে দেখিয়া বুঝিতে পারুক সত্য, সরলতা, শ্ৰী যদি মূর্তি গ্ৰহণ করে তবে তাহাকে কেমন দেখিতে হয়। যে গৃহে লক্ষ্মী আছে, সে গৃহে বিশৃঙ্খলা কুশ্রীতা নাই। আজকাল আমরা যে-সমস্ত অনুষ্ঠান করিতেছি তাহার মধ্যে লক্ষ্মীর হস্ত নাই, এইজন্য তাহার মধ্যে বড়ো বিশৃঙ্খলতা, বড়ো বাড়াবাড়ি— তোমরা শিক্ষিতা নারীরা তোমাদের হৃদয়ের সৌন্দর্য লইয়া যদি এই সমাজের মধ্যে এই অসংযত কার্যস্তুপের মধ্যে আসিয়া দাড়াও তবেই ইহার মধ্যে লক্ষ্মীস্থাপনা হয়, তবে অতি সহজেই সমস্ত শোভন পরিপাটি এবং সামঞ্জস্যবদ্ধ হইয়া আসে । চলিয়া গেল । চৈত্র ১২৯৯