পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ぬの8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সমস্ত গর্বিত সভ্যসমাজকে একটি আদর্শ দেখাইতেছে। সেইজন্য লন্ডন-প্যারিসের তুমুল সভ্যতাকোলাহল দূর হইতে সংবাদপত্ৰযোগে কানে আসিয়া বাজিলেও, আমার গ্রামটি আমার হৃদয়ের মধ্যে অদ্য প্ৰধান স্থান অধিকার করিয়াছে । আমার নানাচিস্তাবিক্ষিপ্ত চিত্তের কাছে এই ছােটাে পল্লীটি তানপুরার সরল সুরের মতো একটি নিত্য আদর্শ উপস্থিত করিয়াছে। সে বলিতেছে- আমি মহৎ নহি, বিস্ময়জনক নহি, কিন্তু আমি ছোটোর মধ্যে সম্পূর্ণ, সুতরাং অন্য সমস্ত অভাব সত্ত্বেও আমার যে-একটি মাধুর্য আছে তাহা স্বীকার করিতেই গুঞ্জ, আমি ছােটাে বলিয়া তুচ্ছ কিন্তু সম্পূর্ণ বলিয়া সুন্দর এবং এই সৌন্দর্য তােমাদের জীবনের অনেকে আমার কথায় হাস্য সংবরণ করিতে পরিবেন না, কিন্তু তবু আমার বলা উচিত, এই মূঢ় চাষীদের সুষমাহীন মুখের মধ্যে আমি একটি সৌন্দর্য অনুভব করি যাহা রমণীর সৌন্দর্যের মতো । আমি নিজেই তাহাতে বিস্মিত হইয়াছি এবং চিন্তা করিয়াছি, এ সৌন্দর্য কিসের ! আমার মনে তাহার একটা উত্তরও উদয় হইয়াছে । যাহার প্রকৃতি কোনো-একটি বিশেষ স্থায়ী ভাবকে অবলম্বন করিয়া থাকে, তাহার মুখে সেই ভাব ক্রমশ একটি স্থায়ী লাবণ্য অঙ্কিত করিয়া দেয় । আমার এই গ্ৰাম্য লোক-সকল জন্মাবধি কতকগুলি স্থির ভাবের প্রতি স্থির দৃষ্টি বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, সেই কারণে সেই ভাবগুলি ইহাদের দৃষ্টিতে আপনাকে অঙ্কিত করিয়া দিবার সুদীর্ঘ অবসর পাইয়াছে। সেইজন্য ইহাদের দৃষ্টিতে একটি সকরুণ ধৈর্য, ইহাদের মুখে একটি নির্ভরপরায়ণ বৎসল ভাব, স্থিররূপে প্ৰকাশ পাইতেছে। যাহারা সকল বিশ্বাসকেই প্রশ্ন করে এবং নানা বিপরীত ভাবকে পরখ করিয়া দেখে তাহাদের মুখে একটা বুদ্ধির তীব্রতা এবং সন্ধানপরতার পটুত্ব প্রকাশ পায়, কিন্তু ভাবের গভীর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য হইতে সে অনেক তফাত । আমি যে ক্ষুদ্র নদীটিতে নীেকা লইয়া আছি ইহাতে স্রোত নাই বলিলেও হয়, সেইজন্য এই নদী কুমুদে কহলারে পদ্মে শৈবালে সমাচ্ছন্ন হইয়া আছে। সেইরূপ একটা স্থায়িত্বের অবলম্বন না পাইলে ভাবসৌন্দর্যও গভীরভাবে বদ্ধমূল হইয়া আপনাকে বিকশিত করিবার অবসর পায় না । প্রাচীন যুরোপ নব্য-আমেরিকার প্রধান অভাব অনুভব করে সেই ভাবের । তাহার ঔজ্জ্বল্য আছে, চাঞ্চল্য আছে, কাঠিন্য আছে, কিন্তু ভাবের গভীরতা নাই। সে বড়োই বেশিমাত্রায় নূতন, তাহাতে ভাব জন্মাইবার সময় পায় নাই। এখনো সে সভ্যতা মানুষের সহিত মিশ্রিত হইয়া গিয়া মানুষের হৃদয়ের দ্বারা অনুরঞ্জিত হইয়া উঠে নাই। সত্য মিথ্যা বলিতে পারি না, এইরূপ তো শুনা যায়, এবং আমেরিকার প্রকৃত সাহিত্যের বিরলতায় এইরূপ অনুমান করাও যাইতে পারে। প্রাচীন যুরোপের ছিদ্রে ছিদ্রে কোণে কোণে অনেক শ্যামল পুরাতন ভাব অঙ্কুরিত হইয়া তাহাকে বিচিত্র লাবণ্যে মণ্ডিত করিয়াছে, আমেরিকার সেই লাবণ্যটি নাই। বহু স্মৃতি জনপ্রবাদ বিশ্বাস ও সংস্কারের দ্বারা এখনো তাহাতে মানবজীবনের রঙ ধরিয়া যায় নাই । আমার এই চাষীদের মুখে অন্তঃপ্রকৃতির। সেই রঙ ধরিয়া গেছে! সারল্যের সেই পুরাতন শ্ৰীটুকু সকলকে দেখাইবার জন্য আমার বড়ো একটি আকাঙক্ষা হইতেছে। কিন্তু সেই শ্ৰী এতই সুকুমার যে, কেহ যদি বলেন, “দেখিলাম না” এবং কেহ যদি হাস্য করেন তবে তাহা নির্দেশ করিয়া দেওয়া আমার ক্ষমতার অতীত । এই খবরের কাগজের টুকরাগুলা পড়িতেছি আর আমার মনে হইতেছে যে, বাইবেলে লেখা আছে, যে নম্র সেই পৃথিবীর অধিকার প্রাপ্ত হইবে । আমি যে নম্রতাটুকু এখানে দেখিতেছি। ইহার একটি স্বগীয় অধিকার আছে। পৃথিবীতে সৌন্দর্যের অপেক্ষা নম্র আর-কিছু নাই— সে বলের দ্বারা কোনে কাজ করিতে চায় না— এক সময় পৃথিবী তাঁহারই হইবে। এই-যে গ্রামবাসিনী সুন্দরী সরলতা আজ একটি নগরবাসী নবসভ্যতার পোষ্যপুত্রের মন অতর্কিতভাবে হরণ করিয়া লইতেছে, এক কালে সে