পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܓ ܠ ܬ জীবনপূর্ণ আদরপূর্ণ মৃদু উত্তাপ চতুর্দিক হইতে আমার সর্বাঙ্গে প্রবেশ করিতেছে। তবে এই ভাবে থাকিয়া গেলে ক্ষতি কী ? কাগজ-কলম লইয়া বসিবার জন্য কে তোমাকে খোচাইতেছিল ? কোন বিষয়ে তোমার কী মত, কিসে তোমার সম্মতি বা অসম্মতি, সে কথা লইয়া হঠাৎ ধুমধাম করিয়া কোমর বাধিয়া বসিবার কী দরকার ছিল ? ঐ দেখো, মাঠের মাঝখানে, কোথাও কিছু নাই, একটা ঘূর্ণ বাতাস খানিকটা ধুলা এবং শুকনো পাতার ওড়না উড়াইয়া কেমন চমৎকার ভাবে ঘুরিয়া নাচিয়া গেল ! পদাঙ্গুলিমাত্রের উপর ভর করিয়া দীর্ঘ সরল হইয়া কেমন ভঙ্গিটি করিয়া মুহুর্তকাল দাড়াইল, তাহার পর হুসাহাস করিয়া সমস্ত উড়াইয়া ছড়াইয়া দিয়া কোথায় চলিয়া গেল তাহার ঠিকানা নাই। সম্বল তো ভারি ! গোটাকতক খড়কুটা ধুলাবালি, সুবিধামত যাহা হাতের কাছে আসে তাঁহাই লইয়া বেশ একটু ভাবভঙ্গি করিয়া কেমন একটি খেলা খেলিয়া লইল । এমনি করিয়া জনহীন মধ্যাহ্নে সমস্ত মােঠ-ময় নাচিয়া বেড়ায় । না আছে তাহার কোনো উদ্দেশ্য, না আছে তাহার কেহ দর্শক । না আছে তাহার মত, না আছে তাহার তত্ত্ব ; না আছে সমাজ এবং ইতিহাস সম্বন্ধে অতিসমীচীন উপদেশ । পৃথিবীতে যাহা-কিছু সর্বাপেক্ষা অনাবশ্যক সেই-সমস্ত বিস্মৃত পরিত্যক্ত পদার্থগুলির মধ্যে একটি উত্তপ্ত ফুৎকার দিয়া তাহাদিগকে মুহুর্তকালের জন্য জীবিত জাগ্ৰত সুন্দর করিয়া তোলে। অমনি যদি অত্যন্ত সহজে এক নিশ্বাসে কতকগুলা যাহা-তাহা খাড়া করিয়া সুন্দর করিয়া ঘুরাইয়া উড়াইয়া লাঠিম খেলাইয়া চলিয়া যাইতে পারিতাম। আমনি অবলীলাক্রমে সৃজন করিতাম, আমনি ফু দিয়া ভাঙিয়া ফেলিতাম | চিন্তা নাই, চেষ্টা নাই, লক্ষ্য নাই ; শুধু একটা নৃত্যের আনন্দ, শুধু একটা সৌন্দর্যের আবেগ, শুধু একটা জীবনের ঘূর্ণা ! অবারিত প্রান্তর, অনাবৃত আকাশ, পরিব্যাপ্ত সূর্যালোক— তাহারই মাঝখানে মুঠা মুঠ ধূলি লইয়া ইন্দ্ৰজাল নির্মাণ করা, সে কেবল খ্যাপা হৃদয়ের উদার উল্লাসে । এ হইলে তো বুঝা যায় । কিন্তু বসিয়া বসিয়া পাথরের উপর পাথর চাপাইয়া গলদঘর্ম হইয়া কতকগুলা নিশ্চল মতামত উচ্চ করিয়া তোলা ! তাহার মধ্যে না আছে। গতি, না আছে প্রীতি, না আছে প্ৰাণ ! কেবল একটা কঠিন কীর্তি | তাহাকে কেহ বা ইহা করিয়া দেখে কেহ বা পা দিয়া ঠেলে— যোগ্যতা যেমনি থাক ! কিন্তু ইচ্ছা করিলেও এ কাজে ক্ষান্ত হইতে পারি। কই । সভ্যতার খাতিরে মানুষ মন-নামক আপনার এক অংশকে অপরিমিত প্রশ্রয় দিয়া অত্যন্ত বাড়াইয়া তুলিয়াছে, এখন তুমি যদি তাহাকে ছাড়িতে চাও সে তোমাকে ছাড়ে না । লিখিতে লিখিতে আমি বাহিরে চাহিয়া দেখিতেছি। ঐ একটি লোক রৌদ্রনিবারণের জন্য মাথায় একটি চাদর চাপাইয়া দক্ষিণ হস্তে শালপাতের ঠোঙায় খানিকটা দহি লইয়া রন্ধনশালা অভিমুখে চলিয়াছে। ওটি আমার ভৃত্য, নাম নারায়ণ সিং । দিব্য হৃষ্টপুষ্ট, নিশ্চিন্ত, প্রফুল্লচিত্ত। উপযুক্ত সারপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত পল্লবপূর্ণ মসৃণ চিকুণ কঁঠালগাছটির মতো। এইরূপ মানুষ এই বহিঃপ্রকৃতির সহিত ঠিক মিশ খায়। প্রকৃতি এবং ইহার মাঝখানে বড়ো একটা বিচ্ছেদচিহ্ন নাই। এই জীবধাত্রী শস্যশালিনী বৃহৎ বসুন্ধরার অঙ্গসংলগ্ন হইয়া এ লোকটি বেশ সহজে বাস করিতেছে, ইহার নিজের মধ্যে নিজের তিলমাত্র বিরোধ-বিসংবাদ নাই। ঐ গাছটি যেমন শিকড় হইতে পল্লবাগ্র পর্যন্ত কেবল একটি আতাগাছা হইয়া উঠিয়াছে, তাহার আর-কিছুর জন্য কোনো মাথাব্যথা নাই, আমার হৃষ্টপুষ্ট নারায়ণ সিংটি তেমনি আদ্যোপান্ত কেবলমাত্র একখানি আস্ত নারায়ণ সিং । কোনো কৌতুকপ্রিয় শিশু-দেবতা যদি দুষ্টামি করিয়া ঐ আতাগাছটির মাঝখানে কেবল একটি ফোটা মন ফেলিয়া দেয় ! তবে ঐ সরস শ্যামল দারুজীবনের মধ্যে কী এক বিষম উপদ্রব বাধিয়া যায় ! তবে চিন্তায় উহার চিকন সবুজ পাতাগুলি ভূৰ্জপত্রের মতো পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া যায়, এবং গুড়ি হইতে প্রশাখা পর্যন্ত বৃদ্ধের ললাটের মতো কুঞ্চিত হইয়া আসে। তখন বসন্তকালে আর কি আমন দুই-চারি দিনের মধ্যে সর্বাঙ্গ কচিপাতায় পুলকিত হইয়া উঠে ? ঐ গুটি-আঁকা গোল গোল গুচ্ছ গুচ্ছ ফলে প্ৰত্যেক শাখা ভরিয়া যায় ? তখন সমস্ত দিন এক পায়ের উপর দাড়াইয়া দাড়াইয়া ভাবিতে