পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܟ ܠ ܬ হইতে আর ঐ জ্যোতিঃসিঞ্চিত আকাশ পর্যন্ত তাহার এই প্ৰকাণ্ড ঘরকন্নার মধ্যে একটা ভিন্নদেশী পরের ছেলে প্ৰবেশ লাভ করিয়া দৌরাত্ম্য করিতেছে না । সে একাকী, অখণ্ডসম্পূর্ণ, নিশ্চিন্ত, নিরুদবিগ্ন । তাহার অসীমনীল ললাটে বুদ্ধির রেখামাত্ৰ নাই, কেবল প্রতিভার জ্যোতি চিরদীপ্যমান। যেমন অনায়াসে একটি সর্বাঙ্গসুন্দরী পুষ্পমঞ্জরী বিকশিত হইয়া উঠিতেছে তেমনি অবহেলে একটা দুৰ্দান্ত ঝড় আসিয়া সুখস্বপ্নের মতো সমস্ত ভাঙিয়া দিয়া চলিয়া যাইতেছে । সকলই যেন ইচ্ছায় হইতেছে, চেষ্টায় হইতেছে না । সে ইচ্ছা কখনো আদর করে, কখনো আঘাত করে। কখনো প্ৰেয়সী অন্সরীর মতো গান করে, কখনো ক্ষুধিত রাক্ষসীর ন্যায় গর্জন করে । চিন্তাপীড়িত সংশয়াপন্ন মানুষের কাছে এই দ্বিধাশূন্য অব্যবস্থিত ইচ্ছাশক্তির বড়ো একটা প্ৰচণ্ড আকর্ষণ আছে। রাজভক্তি, প্ৰভুভক্তি তাহার একটা নিদর্শন। যে রাজা ইচ্ছা করিলেই প্ৰাণ দিতে এবং প্ৰাণ লইতে পারে তাহার জন্য যত লোক ইচ্ছা করিয়া প্ৰাণ দিয়াছে, বর্তমান যুগের নিয়মপাশাবদ্ধ রাজার জন্য এত লোক স্বেচ্ছাপূর্বক আত্মবিসর্জনে উদ্যত হয় না। যাহারা মনুষ্যজাতির নেতা হইয়া জন্মিয়াছে তাহাদের মন দেখা যায় না। তাহারা কেন কী ভাবিয় কী যুক্তি অনুসারে কী কাজ করিতেছে, তৎক্ষণাৎ তাহা কিছুই বুঝা যায় না— এবং মানুষ নিজের সংশয়তিমিরাচ্ছন্ন ক্ষুদ্র গহবর হইতে বাহির হইয়া পতঙ্গের মতো ঝাকে বঁাকে তাহাদের মহত্ত্বশিখার মধ্যে আত্মঘাতী হইয়া বাপ দেয় । রমণীও প্রকৃতির মতো । মন আসিয়া তাহাকে মাঝখান হইতে দুই ভাগ করিয়া দেয় নাই। সে পুষ্পের মতো আগাগোড়া একখানি । এইজন্য তাহার গতিবিধি আচারব্যবহার এমন সহজসম্পূৰ্ণ । এইজন্য দ্বিধান্দোলিত পুরুষের পক্ষে রমণী “মরণং ধ্রুবং’ । প্রকৃতির ন্যায় রমণীরও কেবল ইচ্ছাশক্তি- তাহার মধ্যে যুক্তিতর্ক বিচার-আলোচনা কেন-কি-বৃত্তান্ত নাই। কখনাে সে চারি হস্তে অন্ন বিতরণ করে, কখনাে সে প্রলয়মূর্তিতে সংহার করিতে উদ্যত হয় । ভক্তেরা করজোড়ে বলে, তুমি মহামায়া, তুমি ইচ্ছাময়ী, তুমি প্রকৃতি, তুমি শক্তি ! সমীর হীপ ছাড়িবার জন্য একটু থামিবামাত্র ক্ষিতি গভীর মুখ করিয়া কহিল— বাঃ ! চমৎকার ! কিন্তু তোমার গা ছুইয়া বলিতেছি, এক বর্ণ যদি বুঝিয়া থাকি ! বোধ করি তুমি যাহাকে মন ও বুদ্ধি বলিতেছ। প্রকৃতির মতো আমার মধ্যেও সে জিনিসটার অভাব আছে, কিন্তু তৎপরিবর্তে প্ৰতিভার জন্যও কাহারও নিকট হইতে প্ৰশংসা পাই নাই এবং আকর্ষণশক্তিও যে অধিক আছে তাহার কোনো 2उन्फ अभ० °ों92ों यांश कीं । দীপ্তি সমীরকে কহিল- তুমি যে মুসলমানের মতো কথা কহিলে, তাহাদের শাস্ত্ৰেই তো বলে মেয়েদের আত্মা নাই । স্রোতস্বিনী চিন্তান্বিতভাবে কহিল— মন এবং বুদ্ধি শব্দটা যদি তুমি একই অর্থে ব্যবহার কর আর যদি বলা আমরা তাহা হইতে বঞ্চিত, তবে তোমার সহিত আমার মতের মিল হইল না । সমীর কহিল- আমি যে কথাটা বলিয়াছি তাহা রীতিমত তর্কের যোগ্য নহে। প্রথম বর্ষায় পদ্মা যে চরটা গড়িয়া দিয়া গেল, তাহা বালি, তাহার উপরে লাঙল লইয়া পড়িয়া তাহাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিলে কোনো ফল পাওয়া যায় না ; ক্রমে ক্ৰমে দুই-তিন বর্ষায় স্তরে স্তরে যখন তাহার উপর মাটি পড়িবে তখন সে কর্ষণ সহিবে । আমিও তেমনি চলিতে চলিতে স্রোতেবেগে একটা কথাকে কেবল প্ৰথম দাড় করাইলাম মাত্র । হয়তো দ্বিতীয় স্রোতে একেবারে ভাঙিতেও পারে, অথবা পলি পড়িয়া ভুল হইতেও আটক নাই। যাহা হউক, আসামির সমস্ত কথাটা শুনিয়া তার পর বিচার করা - মানুষের অন্তঃকরণের দুই অংশ আছে। একটা অচেতন বৃহৎ গুপ্ত এবং নিশ্চেষ্ট, আর-একটা সচেতন সক্রিয় চঞ্চল পরিবর্তনশীল । যেমন মহাদেশ এবং সমুদ্র । সমুদ্র চঞ্চলভাবে যাহা-কিছু সঞ্চয় করিতেছে, ত্যাগ করিতেছে, গোপন-তলদেশে তাঁহাই দৃঢ় নিশ্চল আকারে উত্তরোত্তর রাশীকৃত হইয়া