পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভুত à o গদ্য ও পদ্য আমি বলিতেছিলাম— বাঁশির শব্দে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়, কবিরা বলেন, হৃদয়ের মধ্যে স্মৃতি জাগিয়া উঠে। কিন্তু কিসের স্মৃতি তাহার কোনো ঠিকানা নাই। যাহার কোনো নির্দিষ্ট আকার নাই তাহাকে এত দেশ থাকিতে স্মৃতিই বা কেন বলিব, বিস্মৃতিই বা না বলিব কেন, তাহার কোনো কারণ পাওয়া যায় না । কিন্তু ‘বিস্মৃতি জাগিয়া ওঠে এমন একটা কথা ব্যবহার করিলে শুনিতে বড়ো অসংগত বোধ হয় । অথচ কথাটা নিতান্ত অমূলক নহে। অতীত জীবনের যে-সকল শত সহস্ৰ স্মৃতি স্বাতন্ত্র্য পরিহার করিয়া একাকার হইয়াছে, যাহাদের প্রত্যেককে পৃথক করিয়া চিনিবার জো নাই, আমাদের হৃদয়ের চেতন মহাদেশের চতুর্দিক বেষ্টন করিয়া যাহারা বিস্মৃতিমহাসাগররূপে নিস্তব্ধ হইয়া শয়ন আছে, তাহারা কোনো কোনো সময়ে চন্দ্ৰোদয়ে অথবা দক্ষিণের বায়ুবেগে একসঙ্গে চঞ্চল ও তরঙ্গিত হইয়া তাহাদের রহস্যপূর্ণ অগাধ অস্তিত্ব উপলব্ধ হয়, সেই মহাবিস্মৃত অতিবিস্মৃত বিপুলতার একতান ক্ৰন্দনধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায় । শ্ৰীযুক্ত ক্ষিতি আমার এই আকস্মিক ভাবোচ্ছাসে হাস্যসংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন— ভ্ৰাতঃ, করিতেছ। কী ! এইবেলা সময় থাকিতে ক্ষান্ত হও । কবিতা ছন্দে শুনিতেই ভালো লাগে, তাহাও সকল সময়ে নহে । কিন্তু সরল গদ্যের মধ্যে যদি তোমরা পাচজনে পড়িয়া কবিতা মিশাইতে থাক, তবে তাহা প্রতিদিনের ব্যবহারের পক্ষে অযোগ্য হইয়া উঠে । বরং দুধে জল মিশাইলে চলে, কিন্তু জলে দুধ মিশাইলে তাহাতে প্রাত্যহিক স্নান-পান চলে না । কবিতার মধ্যে কিয়ৎপরিমাণে গদ্য মিশ্রিত করিলে আমাদের মতো গদ্যজীবী লোকের পরিপাকের পক্ষে সহজ হয়- কিন্তু গদ্যের মধ্যে কবিত্ব একেবারে অচল । বাস। মনের কথা আর নহে। আমার শরৎপ্ৰভাতের নবীন ভাবান্ধুরটি প্ৰিয়বন্ধু ক্ষিতি তাহার তীক্ষ নিড়ানির একটি খোচায় একেবারে সমূলে উৎপাটিত করিয়া দিলেন। একটা তর্কের কথায় সহসা বিরুদ্ধ মত শুনিলে মানুষ তেমন অসহায় হইয়া পড়ে না, কিন্তু ভাবের কথায় কেহ মাঝখানে ব্যাঘাত করিলে বড়োই দুর্বল হইয়া পড়িতে হয়। কারণ, ভাবের কথায় শ্রোতার সহানুভূতির প্রতিই একমাত্র নির্ভর । শ্রোতা যদি বলিয়া উঠে ‘কী পাগলামি করিতেছ, তবে কোনো যুক্তিশাস্ত্রে তাহার কোনো উত্তর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না । এইজন্য ভাবের কথা পাড়িতে হইলে প্রাচীন গুণীরা শ্রোতাদের হাতে-পায়ে ধরিয়া কাজ আরম্ভ করিতেন । বলিতেন, সুধীগণ মর্যালের মতো নীর পরিত্যাগ করিয়া ক্ষীর গ্রহণ করেন। নিজের অক্ষমতা স্বীকার করিয়া সভাস্থ লোকের গুণগ্ৰাহিতার প্রতি একান্ত নির্ভর প্রকাশ করিতেন । কখনো বা ভবভূতির ন্যায় সুমহৎ দম্ভের দ্বারা আরম্ভ হইতেই সকলকে অভিভূত করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেন । এবং এত করিয়াও ঘরে ফিরিয়া আপনাকে ধিক্কার দিয়া বলিতেন, যে দেশে কাচ এবং মানিকের এক দর, সে দেশকে নমস্কার । দেবতার কাছে প্রার্থনা করিতেন, “হে চতুমুখ, পাপের ফল আর যেমনই দাও সহ্য করিতে প্ৰস্তুত আছি, কিন্তু অরসিকের কাছে রসের কথা বলা এ কপালে লিখিয়ো না, লিখিয়ো না, লিখিয়ো না ।” বাস্তবিক এমন শাস্তি আর নাই | জগতে অৱসিক না থাকুক, এতবড়ো প্রার্থনা দেবতার কাছে করা যায় না, কারণ তাহা হইলে জগতের জনসংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস হইয়া যায়। অরসিকের দ্বারাই পৃথিবীর অধিকাংশ কার্য সম্পন্ন হয়, তাহারা জনসমাজের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় ; তাহারা না থাকিলে সভা বন্ধ, কমিটি অচল, সংবাদপত্র নীরব, সমালোচনার কোটা একেবারে শূন্য ; এজন্য তাহাদের প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান আছে। কিন্তু ঘানিযন্ত্রে সর্ষপ ফেলিলে অজস্রধারে তৈল বাহির হয় বলিয়া তাহার মধ্যে ফুল ফেলিয়া কেহ মধুর প্রত্যাশা করিতে পারে না— অতএব হে চতুর্মুখ, ঘানিকে চিরদিন সংসারে রক্ষা করিয়ো, কিন্তু তাহার মধ্যে ফুল ফেলিয়ো না এবং গুণীজনের হৃৎপিণ্ড নিক্ষেপ করিয়ো না ।