পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভুত છે ૨છે গ্ৰহণ করাও নিতান্ত সহজ নহে ; তাহার জন্যও বিবিধ প্রকার শিক্ষা এবং সাহায্যের প্রয়োজন । সেইজন্যই বলিতেছিলাম, দেখিতে দেখিতে মন এতটা অগ্রসর হইয়া যায় যে, তাহার নাগাল পাইবার জন্য সিঁড়ি লাগাইতে হয় । যদি কেহ অভিমান করিয়া বলেন, যাহা বিনা শিক্ষায় না জানা যায় তাহা বিজ্ঞান নহে, যাহা বিনা চেষ্টায় না বোঝা যায় তাহা দৰ্শন নহে এবং যাহা বিনা সাধনায় আনন্দ দান না। করে তাহা সাহিত্য নহে, তবে কেবল খনার বচন, প্রবাদবাক্য এবং পাচলি অবলম্বন করিয়া তাহাকে অনেক পশ্চাতে পড়িয়া থাকিতে হইবে । সমীর কহিল- মানুষের হাতে সব জিনিসই ক্রমশ কঠিন হইয়া উঠে । অসভেরা যেমন-তেমন চীৎকার করিয়াই উত্তেজনা অনুভব করে, অথচ আমাদের এমনি গ্ৰহ যে বিশেষ অভ্যাসসাধ্য শিক্ষাসাধ্য সংগীত, ব্যতীত আমাদের সুখ নাই, আরো গ্ৰহ এই যে ভালো গান করাও যেমন শিক্ষাসাধ্য, ভালো গান হইতে সুখ অনুভব করাও তেমনি শিক্ষাসাধ্য। তাহার ফল হয়। এই যে, এক সময়ে যাহা সাধারণের ছিল, ক্রমেই তাহা সাধকের হইয়া আসে । চীৎকার সকলেই করিতে পারে এবং চীৎকার করিয়া অসভ্য সাধারণে সকলেই উত্তেজনাসুখ অনুভব করে, কিন্তু গান সকলে করিতে পারে না এবং গানে সকলে সুখও পায় না। কাজেই সমাজ যতই অগ্রসর হয় ততই অধিকারী এবং অনধিকারী, রসিক এবং অরসিক, এই দুই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইতে থাকে । ক্ষিতি কহিল— মানুষ বেচারাকে এমনি করিয়া গড়া হইয়াছে যে, সে যতই সহজ উপায় অবলম্বন করিতে যায় ততই দুরূহতার মধ্যে জড়ীভূত হইয়া পড়ে। সে সহজে কাজ করিবার জন্য কল তৈরি করে, কিন্তু কল জিনিসটা নিজে এক বিষম দুরূহ ব্যাপার ; সে সহজে সমস্ত প্ৰাকৃত জ্ঞানকে বিধিবদ্ধ করিবার জন্য বিজ্ঞান সৃষ্টি করে, কিন্তু সেই বিজ্ঞানটাই আয়ত্ত করা কঠিন কাজ ; সুবিচার করিবার সহজ প্ৰণালী বাহির করিতে গিয়া আইন বাহির হইল, শেষকালে আইনটা ভালো করিয়া বুঝিতেই দীর্ঘজীবী লোকের বারো-আনা জীবন দান করা আবশ্যক হইয়া পড়ে ; সহজে আদানপ্ৰদান চালাইবার জন্য টাকার সৃষ্টি হইল, শেষকালে টাকার সমস্যা এমনি একটা সমস্যা হইয়া উঠিয়াছে যে, মীমাংসা করে কাহার সাধ্য ! সমস্ত সহজ করিতে হইবে এই চেষ্টায় মানুষের জানাশোনা খাওয়াদাওয়া আমোদপ্রমোদ সমস্তই অসম্ভব শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। স্রোতস্বিনী কহিলেন- সেই হিসাবে কবিতাও শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। এখন মানুষ খুব স্পষ্টত দুই ভাগ হইয়া গিয়াছে- এখন অল্প লোকে ধনী এবং অনেকে নির্ধন, অল্প লোকে গুণী এবং অনেকে নিগুণ- এখন কবিতাও সর্বসাধারণের নহে, তাহা বিশেষ লোকের । সকলই বুঝিলাম। কিন্তু কথাটা এই যে, আমরা যে বিশেষ কবিতার প্রসঙ্গে এই কথাটা তুলিয়াছি সে কবিতাটা কোনো অংশেই শক্ত নহে, তাহার মধ্যে এমন কিছুই নাই যাহা আমাদের মতো লোকও বুঝিতে না পারে, তাহা নিতান্তই সরল- অতএব তাহা যদি ভালো না লাগে। তবে সে আমাদের বুঝিবার দোষে নহে। ক্ষিতি এবং সমীর ইহার পরে আর কোনো কথা বলিতে ইচ্ছা করিল না । কিন্তু ব্যোম অম্লানমুখে বলিতে লাগিল- যাহা সরল তাহাই যে সহজ এমন কোনো কথা নাই। অনেক সময় তাহাই অত্যন্ত কঠিন ; কারণ, সে নিজেকে বুঝাইবার জন্য কোনোপ্রকার বাজে উপায় অবলম্বন করে না, সে চুপ করিয়া দাড়াইয়া থাকে ; তাহাকে না বুঝিয়া চলিয়া গেলে সে কোনোরূপ কৌশল করিয়া ফিরিয়া ডাকে না । প্ৰাঞ্জলতার প্রধান গুণ এই যে, সে একেবারে অব্যবহিত ভাবে মনের সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করে, তাহার কোনো মধ্যস্থ নাই। কিন্তু যে-সকল মন মধ্যাস্থের সাহায্য ব্যতীত কিছু গ্ৰহণ করিতে পারে না, যাহাদিগকে ভুলইয়া আকর্ষণ করিতে হয়, প্রাঞ্জলতা তাঁহাদের নিকট বড়োই দুর্বোধি। কৃষ্ণনগরের কারিগরের রচিত ভিত্তি তাহার সমস্ত রঙ-চঙ মশক এবং অঙ্গভঙ্গি -দ্বারা আমাদের ইন্দ্ৰিয় এবং অভ্যাসের সাহায্যে চট্ৰ করিয়া আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে- কিন্তু গ্ৰীক প্রস্তরমূর্তিতে রঙ-চঙ রকম-সকম নাই, তাহা প্ৰাঞ্জল এবং সর্বপ্রকার-প্ৰয়াস-বিহীন । কিন্তু সরল বলিয়া তাহা সহজ নহে। সে কোনোপ্রকার তুচ্ছ বাহ্য কৌশল অবলম্বন করে না বলিয়াই ভাবসম্পদ তাহার অধিক থাকা চাই । Y Glo