পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত SV9Գ কিন্তু পথে চলিতে চলিতে যদি হঠাৎ দেখি একজন মান্য বৃদ্ধ ব্যক্তি খেমটা নাচ নাচিতেছে, তবে সেটা প্রকৃতই অসংগত ঠেকে ; কারণ, তাহা অনিবাৰ্য নিয়মসংগত নহে। আমরা বৃদ্ধের নিকট কিছুতেই এরূপ আচরণ প্রত্যাশা করি না, কারণ সে ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন লোক- সে ইচ্ছা করিয়া নাচিতেছে, ইচ্ছা করিলে না, নচিতে পারিত। জড়ের নাকি নিজের ইচ্ছামত কিছু হয় না, এইজন্য জড়ের পক্ষে কিছুই অসংগত কৌতুকাবহ হইতে পারে না । এইজন্য অনপেক্ষিত হুঁচটি বা দুৰ্গন্ধ হাস্যজনক নহে। চায়ের চামচ যদি দৈবাৎ চায়ের পেয়ালা হইতে চুত হইয়া দোয়াতের কালির মধ্যে পড়িয়া যায়। তবে সেটা চামচের পক্ষে হাস্যকর নহে ; ভারাকর্ষণের নিয়ম তাহার লঙঘন করিবার জো নাই ; কিন্তু অন্যমনস্ক লেখক যদি তাহার চায়ের চামচ দোয়াতের মধ্যে ডুবাইয়া চা খাইবার চেষ্টা করেন তবে সেটা কৌতুকের বিষয় বটে । নীতি যেমন জড়ে নাই, অসংগতিও সেইরূপ জড়ে নাই । মনঃপদার্থ প্রবেশ করিয়া যেখানে দ্বিধা জন্মাইয়া দিয়াছে সেইখানেই উচিত এবং অনুচিত, সংগত এবং ज्ञङ्गुट्ठ । - কৌতুহল জিনিসটা অনেক স্থলে নিষ্ঠুর ; কৌতুকের মধ্যেও নিষ্ঠুরতা আছে। সিরাজউদ্দৌলা দুইজনের দাডিতে দাড়িতে বাধিয়া উভয়ের নাকে নস্য পুরিয়া দিতেন এইরূপ প্ৰবাদ শুনা যায়উভয়ে যখন হাচিতে আরম্ভ করিত তখন সিরাজউদ্দৌলা আমোদ অনুভব করিতেন । ইহার মধ্যে অসংগতি কোনখানে ? নাকে নস্য দিলে তো হাঁচি আসিবারই কথা । কিন্তু এখানেও ইচ্ছার সহিত কার্যের অসংগতি । যাহাদের নাকে নস্য দেওয়া হইতেছে তাহাদের ইচ্ছা নয় যে তাহারা হচে, কারণ, হাঁচিলেই তাহাদের দাড়িতে অকস্মাৎ টান পড়িবে, কিন্তু তথাপি তাহাদিগকে হাঁচিতেই হইতেছে। এইরূপ ইচ্ছার সহিত অবস্থার অসংগতি, উদ্দেশ্যের সহিত উপায়ের অসংগতি, কথার সহিত কার্যের অসংগতি, এগুলোর মধ্যে নিষ্ঠুরতা আছে। অনেক সময় আমরা যাহাকে লইয়া হাসি সে নিজের অবস্থাকে হাস্যের বিষয় জ্ঞান করে না । এইজন্যই পাঞ্চভৌতিক সভায় ব্যোম বলিয়াছিলেন যে, কমেডি এবং ট্র্যাজেডি কেবল পীড়নের মাত্রাভেদ মাত্র । কমেডিতে যতটুকু নিষ্ঠুরতা প্রকাশ হয় তাহাতে আমাদের হাসি পায় এবং ট্র্যাজেডিতে যতদূর পর্যন্ত যায় তাহাতে আমাদের চােখে জল আসে। গর্দভের নিকট অনেক টাইটিনিয়া অপূর্বমোহবশত যে আত্মবিসর্জন করিয়া থাকে তাহা মাত্রাভেদে এবং পাত্ৰভেদে মর্মভেদী শোকের কারণ হইয়া উঠে । অসংগতি কমেডিরও বিষয়, অসংগতি ট্র্যাজেডিরও বিষয় । কমেডিতেও ইচ্ছার সহিত অবস্থার অসংগতি প্রকাশ পায় । ফলস্টাফ উইন্ডসর-বাসিনী রঙ্গিণীর প্রেমলালসায় বিশ্বাস্তচিত্তে অগ্রসর হইলেন, কিন্তু দুৰ্গতির একশেষ লাভ করিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। রামচন্দ্র যখন রাবণবধ করিয়া, বনবাসপ্রতিজ্ঞা পূরণ করিয়া, রাজ্যে ফিরিয়া আসিয়া, দাম্পত্যসুখের চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছেন, এমন সময় অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজাঘাত হইল, গর্ভবতী সীতাকে অরণ্যে নির্বাসিত করিতে বাধ্য হইলেন । উভয় স্থলেই আশার সহিত ফলের, ইচ্ছার সহিত অবস্থার অসংগতি প্ৰকাশ পাইতেছে। অতএব স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, অসংগতি দুই শ্রেণীর আছে ; একটা হাস্যজনক, আর-একটা দুঃখজনক। বিরক্তিজনক, বিস্ময়জনক, রোষজনক-কেও আমরা শেষ শ্রেণীতে ফেলিতেছি। অর্থাৎ অসংগতি যখন আমাদের মনের অনতিগভীর স্তরে আঘাত করে তখনই আমাদের কৌতুক বোধ হয়, গভীরতর স্তরে আঘাত করিলে আমাদের দুঃখ বোধ হয় । শিকারী যখন অনেকক্ষণ অনেক তাক করিয়া হংসভ্রমে একটা দূরস্থ শ্বেত পদার্থের প্রতি গুলি বর্ষণ করে এবং ছুটিয়া কাছে গিয়া দেখে সেটা একটা ছিন্ন বস্ত্রখণ্ড, তখন তাহার সেই নৈরাশ্যে আমাদের হাসি পায় ; কিন্তু কোনো লোক যাহাকে আপন জীবনের পরম পদার্থ মনে করিয়া একাগ্রচিত্তে একান্ত চেষ্টায় আজন্মকাল তাহার অনুসরণ করিয়াছে এবং অবশেষে সিদ্ধ।কাম হইয়া তাহাকে হাতে লইয়া দেখিয়াছে সে তুচ্ছ প্ৰবঞ্চনামাত্র, তখন তাহার সেই নৈরাশ্যে অন্তঃকরণ ব্যথিত হয় । দুর্ভিক্ষে যখন দলে দলে মানুষ মরিতেছে তখন সেটাকে প্রহসনের বিষয় বলিয়া কাহারও মনে হয় না। কিন্তু আমরা অনায়াসে কল্পনা করিতে পারি, একটা রসিক শয়তানের নিকট ইহা পরামকৌতুকাবহ