পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত s)○ぬ ক্ষিতি কহিল— আমাদের দেশের কাব্যে নারীদেহের বর্ণনায় যেখানে উচ্চতা বা গোলতা বুঝাইবার আবশ্যক হইয়াছে সেখানে কবিরা অনায়াসে গভীর মুখে সুমেরু এবং মেদিনীর অবতারণা করিয়াছেন, তাহার কারণ, অ্যাবসট্র্যাক্টের দেশে পরিমাণ-বিচারের আবশ্যকতা নাই ; গোরুর পিঠের কুঁজও উচ্চ, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরও উচ্চ ; অতএব অ্যাবসট্র্যাক্ট উচ্চতাটুকু মাত্র ধরিতে গেলে গোরুর পিঠের কুঁজের সহিত কাঞ্চনজঙঘার তুলনা করা যাইতে পারে ; কিন্তু যে হতভাগ্য কাঞ্চনজঙঘার উপমা শুনিবামাত্র কল্পনাপটে হিমালয়ের শিখর চিত্ৰিত দেখিতে পায়, যে বেচারা গিরিচুড়া হইতে আলগোছে মুশকিল। ভাই সমীর, তোমার আজিকার এই কথাটা ঠিক মনে লাগিতেছে- প্ৰতিবাদ না করিতে পারিয়া অত্যন্ত দুঃখিত আছি । ব্যোম কহিল— কিছু প্ৰতিবাদ করিবার নাই তাহা বলিতে পারি না । সমীরের মতটা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে বলা আবশ্যক । আসল কথাটা এই, আমরা অন্তর্জগৎবিহারী । বাহিরের জগৎ আমাদের নিকট প্রবল নহে । আমরা যাহা মনের মধ্যে গড়িয়া তুলি বাহিরের জগৎ তাহার প্রতিবাদ করিলে সে প্রতিবাদ গ্রাহাই করি না । যেমন ধূমকেতুর লঘু পুচ্ছটা কোনো গ্রহের পথে আসিয়া পড়িলে তাহার পুচ্ছেরই ক্ষতি হইতে পারে। কিন্তু গ্ৰহ অপ্ৰতিহত ভাবে অনায়াসে চলিয়া যায়, তেমনি বহির্জগতের সহিত আমাদের অন্তর্জগতের রীতিমত সংঘাত কোনোকালে হয় না ; হইলে বহির্জগৎটাই হঠিয়া যায় । যাহাদের কাছে হাতিটা অত্যন্ত প্ৰত্যক্ষ প্রবল সত্য, তাহারা গজেন্দ্রগমনের উপমায় গজেন্দ্ৰটাকে বেমালুম বাদ দিয়া কেবল গমনটুকুকে রাখিতে পারে না— গজেন্দ্ৰ বিপুল দেহ বিস্তারপূর্বক অটলভাবে কাব্যের পথরোধ করিয়া দাড়াইয়া থাকে । কিন্তু আমাদের কাছে গজ বলো, গজেন্দ্ৰ বলো, কিছুই কিছু নয় । সে আমাদের কাছে এত অধিক জাজ্বল্যমান নহে যে, তাহার গমনটুকু রাখিতে হইলে তাহাকে সুদ্ধ পুষিতে হইবে । ক্ষিতি কহিল— আমরা অন্তরে বঁাশের কেল্লা বাধিয়া তীতুমীরের মতো বহিঃপ্রকৃতির সমস্ত ‘গোলা পারে না । কাব্যে কেন, জ্ঞানরাজ্যেও আমরা বহির্জগৎকে খাতিরমাত্র করি না । একটা সহজ উদাহরণ মনে পড়িতেছে । আমাদের সাত সুর ভিন্ন ভিন্ন পশুপক্ষীর কণ্ঠস্বর হইতে প্ৰাপ্ত, ভারতবর্ষীয় সংগীতশাস্ত্রে এই প্ৰবাদ বহুকাল চলিয়া আসিতেছে- এ পর্যন্ত আমাদের ওস্তাদদের মনে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহমাত্ৰ উদয় হয় নাই, অথচ বহির্জগৎ হইতে প্ৰতিদিনই তাহার প্রতিবাদ আমাদের কানে আসিতেছে। স্বরমালার প্রথম সুরাটা যে গাধার সুর হইতে চুরি এরূপ পরমাশ্চর্য কল্পনা কেমন করিয়া যে কোনো সুরজ্ঞ ব্যক্তির মনে উদয় হইল তাহা আমাদের পক্ষে স্থির করা দুরূহ। ব্যোম কহিল- গ্রীকদের নিকট বহির্জগৎ বাষ্পবৎ মরীচিকাবৎ ছিল না, তাহা প্ৰত্যক্ষ জাজ্বল্যমান ছিল, এইজন্য অত্যন্ত যত্নসহকারে তাহাদিগকে মনের সৃষ্টির সহিত বাহিরের সৃষ্টির সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে হইত। কোনো বিষয়ে পরিমাণ লঙঘন হইলে বাহিরের জগৎ আপন মাপকাঠি লইয়া তাহাদিগকে লজ্জা দিত। সেইজন্য র্তাহারা আপন দেব-দেবীর মূর্তি সুন্দর এবং স্বাভাবিক করিয়া গড়িতে বাধ্য হইয়াছিলেন— নতুবা জাগতিক সৃষ্টির সহিত র্তাহাদের মনের সৃষ্টির একটা প্রবল সংঘাত বাধিয়া তাহদের ভক্তির ও আনন্দের ব্যাঘাত করিত । আমাদের সে ভাবনা নাই । আমরা আমাদের দেবতাকে যে মূর্তিই দিই-না কেন, আমাদের কল্পনার সহিত বা বহির্জগতের সহিত তাহার কোনো বিরোধ ঘটে না । মুষিকবাহন চতুর্ভুজ একদন্ত লম্বোেদর গজানন মূর্তি আমাদের নিকট হাস্যজনক নহে, কারণ আমরা সেই মূর্তিকে আমাদের মনের ভাবের মধ্যে দেখি, বাহিরের জগতের সহিত, চারিদিকের সত্যের সহিত তাহার তুলনা করি না । কারণ, বাহিরের জগৎ আমাদের নিকট তেমন প্রবল নহে, প্রত্যক্ষ সত্য আমাদের নিকট তেমন সুদৃঢ় নহে, আমরা যে-কোনো একটা উপলক্ষ অবলম্বন করিয়া নিজের মনের ভাবটাকে জাগ্ৰত করিয়া রাখিতে পারি । সমীর কহিল- যেটাকে উপলক্ষ করিয়া আমরা প্রেম বা ভক্তির উপভোগ অথবা সাধনা করিয়া