পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত S8 প্রসারিত ; এই আবিষ্কারটি লইয়া আমরা আজকাল আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ করিয়া থাকি । কিন্তু এই আনন্দ এই বিস্ময় মানুষের যথার্থ স্বাভাবিক নহে। সে অনন্ত, আকাশে জ্যোতিষ্করাজ্যের মধ্যে যখন অনুসন্ধানদূত প্রেরণ করিয়াছিল তখন বড়ো আশা করিয়াছিল যে, ঐ জ্যোতির্ময় অন্ধকারময় ধামে ধূলিকণার নিয়ম নাই, সেখানে অত্যাশ্চর্য একটা স্বগীয় অনিয়মের উৎসব, কিন্তু এখন দেখিতেছে ঐ চন্দ্ৰসূৰ্য গ্রহনক্ষত্র, ঐ সপ্তর্ষিমণ্ডল, ঐ অশ্বিনী ভরণী কৃত্তিকা আমাদের এই ধূলিকণারই জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ। সহােদর-সহােদরা । এই নূতন তথ্যটি লইয়া আমরা যে আনন্দ প্রকাশ করি, তাহা আমাদের একটা নূতন কৃত্ৰিম অভ্যাস, তাহা আমাদের আদিম প্রকৃতিগত নহে। সমীর কহিল- সে কথা বড়ো মিথ্যা নহে। পরশপাথর এবং আলাদিনের প্রদীপের প্রতি প্রকৃতিস্থ মানুষমাত্রেরই একটা নিগৃঢ় আকর্ষণ আছে। ছেলেবেলায় কথামালার এক গল্প পড়িয়ছিলাম যে, , কোনো কৃষক মরিবার সময় তার পুত্রকে বলিয়া গিয়াছিল যে, অমুক ক্ষেত্রে তোমার জন্য আমি গুপ্তধন রাখিয়া গেলাম । সে বেচারা বিস্তর খুঁড়িয়া গুপ্তধন পাইল না, কিন্তু প্রচুর খননের গুণে সে জমিতে এত শস্য জন্মিল যে তাহার আর অভাব রহিল না। বালকপ্ৰকৃতি বালকমাত্রেরই এ গল্পটি পড়িয়া কষ্ট বোধ হইয়া থাকে। চাষ করিয়া শস্য তো পৃথিবী-সুদ্ধ সকল চাষাই পাইতেছে, কিন্তু গুপ্তধনটা গুপ্ত বলিয়াই পায় না ; তাহা বিশ্বব্যাপী নিয়মের একটা ব্যভিচার, তাহা আকস্মিক, সেইজন্যই তাহা স্বভাবত মানুষের কাছে এত বেশি প্রার্থনীয় । কথামালা যাহাই বলুন, কৃষকের পুত্ৰ তাহার পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হয় নাই সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বৈজ্ঞানিক নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা মানুষের পক্ষে কত স্বাভাবিক আমরা প্রতিদিনই তাহার প্রমাণ পাই। “যে ডাক্তার নিপুণ চিকিৎসার দ্বারা অনেক রোগীর আরোগ্য করিয়া থাকেন, তাহার সম্বন্ধে আমরা বলি লোকটার হাতিযশা আছে । শাস্ত্রসংগত চিকিৎসার নিয়মে ডাক্তার রোগ আরাম করিতেছে। এ কথায় আমাদের আন্তরিক তৃপ্তি নাই ; উহার মধ্যে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমস্বরূপ একটা রহস্য আরোপ করিয়া। তবে আমরা সন্তুষ্ট থাকি । আমি কহিলাম- তাহার কারণ এই যে, নিয়ম অনন্ত কাল ও অনন্ত দেশে প্রসারিত হইলেও তাহা সীমাবদ্ধ, সে আপন চিহ্নিত রেখা হইতে অণুপরিমাণ ইতস্তত করিতে পারে না, সেইজন্যই তাহার নাম নিয়ম এবং সেইজন্যই মানুষের কল্পনাকে সে পীড়া দেয় । শাস্ত্ৰসংগত চিকিৎসার কাছে আমরা অধিক আশা করিতে পারি না- এমন রোগ আছে যাহা চিকিৎসার অসাধ্য ; কিন্তু এ পর্যন্ত হাতিযশ-নামক একটা রহস্যময় ব্যাপারের ঠিক সীমানির্ণয় হয় নাই ; এইজন্য সে আমাদের আশাকে কল্পনাকে কোথাও কঠিন বাধা দেয় না । এইজন্যই ডাক্তারি ঔষধের চেয়ে অবধৌতিক ঔষধের আকর্ষণ অধিক । তাহার ফল যে কত দূর পর্যন্ত হইতে পারে তৎসম্বন্ধে আমাদের প্রত্যাশা সীমাবদ্ধ নহে। মানুষের যত অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি হইতে থাকে, অমোঘ নিয়মের লীেহপ্রাচীরে যতই সে আঘাত প্রাপ্ত হয়, ততই মানুষ আকাঙক্ষা সংযত করিয়া আনে, নিয়মকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করে এবং প্রথমে অনিচ্ছাক্রমে পরে অভ্যাসক্রমে তাহার প্রতি একটা রাজভক্তির উদ্রেক করিয়া তোলে । ব্যোম কহিল— কিন্তু সে ভক্তি যথার্থ অন্তরের ভক্তি নহে, তাহা কাজ আদায়ের ভক্তি। যখন নিতান্ত নিশ্চয় জানা যায় যে, জগৎকার্য অপরিবর্তনীয় নিয়মে বদ্ধ, তখন কাজেই পেট্রের দায়ে প্ৰাণের দায়ে তাহার নিকট ঘাড় হেঁট করিতে হয় ; তখন বিজ্ঞানের বাহিরে অনিশ্চয়ের হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে সাহস হয় না ; তখন মাদুলি তাগা জল-পড়া প্রভৃতিকে গ্ৰহণ করিতে হইলে ইলেকট্রিসিটি ম্যাগ্নেটিজম হিপনটিজম প্রভৃতি বিজ্ঞানের জাল মার্কা দেখিয়া আপনাকে ভুলাইতে হয়। আমরা নিয়ম অপেক্ষা অনিয়মকে যে ভালোবাসি তাহার একটা গোড়ার কারণ আছে । আমাদের নিজের মধ্যে এক জায়গায় আমরা নিয়মের বিচ্ছেদ দেখিতে পাই । আমাদের ইচ্ছাশক্তি সকল নিয়মের বাহিরে- সে স্বাধীন ; অন্তত আমরা সেইরূপ অনুভব করি। আমাদের অন্তরপ্রকৃতিগত সেই স্বাধীনতার সাদৃশ্য বাহ্যপ্রকৃতির মধ্যে উপলব্ধি করিতে স্বভাবতই আমাদের আনন্দ হয়। ইচ্ছার প্রতি ইচ্ছার আকর্ষণ