পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २०S বেষ্টিত নির্জন নিরানন্দ অন্তঃপুর হইতে এ কোন এক সুসজ্জিত সুন্দর উৎসবলোকের প্রাস্তে আসিয়া উপস্থিত হইল। সমস্ত স্বপ্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । সেদিন ‘মানভঞ্জন অপেরা অভিনয় হইতেছে । কখন ঘণ্টা বাজিল, বাদ্য থামিয়া গেল, চঞ্চল দর্শকগণ মুহূর্তে স্থির নিস্তব্ধ হইয়া বসিল, রঙ্গমঞ্চের সম্মুখবর্তী আলোকমালা উজ্জলতর হইয়া উঠিল, পট উঠিয়া গেল, একদল মুসজ্জিত নটী ব্রজাঙ্গনা সাজিয়া সংগীতসহযোগে নৃত্য করিতে লাগিল, দর্শকগণের করতালি ও প্রশংসাবাদে নাট্যশালা থাকিয়া থাকিয়া ধ্বনিত কম্পিত হইয়া উঠিল, তখন গিরিবালার তরুণ দেহের রক্তলহরী উন্মাদনায় আলোড়িত হইতে লাগিল। সেই সংগীতের তানে, আলোক ও আভরণের ছটায়, এবং সম্মিলিত প্রশংসাধ্বনিতে সে ক্ষণকালের জন্য সমাজ সংসার সমস্তই বিস্মৃত হইয়া গেল ; মনে করিল, এমন এক জায়গায় আসিয়াছে যেখানে বন্ধনমুক্ত সৌন্দর্যপূর্ণ স্বাধীনতার কোনো বাধগমাত্র নাই । সুধো মাঝে মাঝে আসিয়া ভীতস্বরে কানে কানে বলে, “বউঠাকরুন, এই বেলা বাড়ি ফিরিয়া চলো ; দাদাবাবু জানিতে পারিলে রক্ষণ থাকিবে না।” গিরিবালা সে কথায় কর্ণপাত করে না। তাহার মনে এখন আর কিছুমাত্র ভয় নাই। অভিনয় অনেক দূর অগ্রসর হইল। রাধার দুর্জয় মান হইয়াছে ; সে মানসাগরে কৃষ্ণ আর কিছুতেই থই পাইতেছে না ; কত অমুনয়বিনয় সাধাসাধি কাদার্কাদি, কিছুতেই কিছু হয় না। তখন গর্বভরে গিরিবালার বক্ষ ফুলিতে লাগিল। কৃষ্ণের এই লাঞ্ছনায় সে যেন মনে মনে রাধা হইয়া নিজের অসীম প্রতাপ নিজে অনুভব করিতে লাগিল। কেহ তাহাকে কখনো এমন করিয়া সাধে নাই ; সে অবহেলিত অবমানিত পরিত্যক্ত স্ত্রী, কিন্তু তবু সে এক অপূর্ব মোহে স্থির করিল যে, এমন করিয়া নিষ্ঠুরভাবে কাদাইবার ক্ষমতা তাহারও আছে। সৌন্দর্যের যে কেমন দোর্দণ্ড প্রতাপ তাহা সে কানে শুনিয়াছে, অনুমান করিয়াছে মাত্ৰ— আজ দীপের আলোকে, গানের স্বরে, স্বদূত রঙ্গমঞ্চের উপরে তাহা স্বম্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করিল। নেশায় তাহার সমস্ত মস্তিষ্ক ভরিয়া উঠিল । অবশেষে যবনিকাপতন হইল, গ্যাসের অালো স্নান হইয়া আসিল, দশকগণ প্রস্থানের উপক্রম করিল ; গিরিবালা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসিয়া রহিল। এখান হইতে উঠিয়া যে বাড়ি যাইতে হইবে এ কথা তাহার মনে ছিল না । সে ভাবিতেছিল অভিনয় বুঝি ফুরাইবে না, যবনিকা আবার উঠিবে। রাধিকার নিকট শ্ৰীকৃষ্ণের পরাভব, জগতে ইহা ছাড়া আর কোনো বিষয় উপস্থিত নাই। স্বধো কহিল, “বউঠাকরুন, করো কী, ওঠে, এখনই সমস্ত আলো নিবাইয়া দিবে।” २०>8