পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २ ०७ করিত— ঝলমল করিয়া, রুমুঝুমু বাজিয়া তাহার চারি দিকে একটি হিল্লোল তুলিতে থাকিত। আজ সে হাতে বাজুবন্ধ এবং গলায় একটি চুনি ও মুক্তার কষ্ঠ পরিয়াছে এবং বামহস্তের কনিষ্ঠ অঙ্গুলিতে একটি নীলার আংটি দিয়াছে। স্বধো পায়ের কাছে বসিয়া মাঝে মাঝে তাহার নিটোল কোমল রক্তোৎপলপদপল্লবে হাত বুলাইতেছিল, এবং অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসের সহিত বলিতেছিল, “আহা বউঠাকরুন, আমি যদি পুরুষমানুষ হইতাম, তাহা হইলে এই পা দুখানি বুকে লইয়া মরিতাম।” গিরিবাল সগৰ্বে হাসিয়া উত্তর দিতেছিল, “বোধ করি বুকে না লইয়াই মরিতে হইত— তখন কি আর এমন করিয়া পা ছড়াইয়া দিতাম। আর বকিস নে। তুই সেই গানটা গা।” সুধো সেই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত নির্জন ছাদের উপর গাহিতে লাগিল— দাসখত দিলেম লিখে শ্রীচরণে, সকলে সাক্ষী থাকুক বৃন্দাবনে। তখন রাত্রি দশটা। বাড়ির আর সকলে আহারাদি সমাধা করিয়া ঘুমাইতে গিয়াছে। এমন সময় আতর মাখিয়া, উড়ানি উড়াইয়া, হঠাৎ গোপীনাথ আসিয়া উপস্থিত হইল— স্থধো অনেকখানি জিভ কাটিয়া সাত হাত ঘোমটা টানিয়া উর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। গিরিবালা ভাবিল, তাহার দিন আসিয়াছে। সে মুখ তুলিয়া চাহিল না । সে রাধিকার মতো গুরুমানভরে অটল হইয়া বসিয়া রহিল। কিন্তু দৃশ্যপট উঠিল না ; শিখিপুচ্ছচুড়া পায়ের কাছে লুটাইল না ; কেহ রাগিণীতে গাহিয়া উঠিল না, "কেন পূর্ণিমা আঁধার কর লুকায়ে বদনশশী।” সংগীতহীন নীরসকণ্ঠে গোপীনাথ বলিল, "একবার চাবিটা দাও দেখি ” এমন জ্যোৎস্নায়, এমন বসন্তে, এতদিনের বিচ্ছেদের পরে এই কি প্রথম সম্ভাষণ ! কাব্যে নাটকে উপন্যাসে যাহা লেখে তাহার আগাগোড়াই মিথ্যা কথা ! অভিনয়মঞ্চেই প্রণয়ী গান গাহিয়া পায়ে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে— এবং তাহাই দেখিয়া যে দর্শকের চিত্ত বিগলিত হইয়া যায় সেই লোকটি বসন্তনিশীথে গৃহছাদে আসিয়া আপন অনুপম৷ যুবতী স্ত্রীকে বলে, “ওগো, একবার চাবিট দাও দেখি।” তাহাতে না আছে রাগিণী, না আছে প্রতি ; তাহাতে কোনো মোহ নাই, মাধুর্য নাই— তাহ অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর । এমন সময়ে দক্ষিনে বাতাস জগতের সমস্ত অপমানিত কবিত্বের মর্মান্তিক দীর্ঘনিশ্বাসের মতো হুহু করিয়া বহিয়া গেল— টব-ভরা ফুটন্ত বেলফুলের গন্ধ ছাদময় ছড়াইয়া দিয়া গেল— গিরিবালার চুর্ণ অলক চোখে মুখে আসিয়া পড়িল এবং তাহার