পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२० রবীন্দ্র-রচনাবলী অগ্রসর হইয়া সকল কাজে হস্তক্ষেপ করিতে যাওয়া, সেও তাহার স্বভাবসিদ্ধ ছিল না । এইরূপ নানাপ্রকার অমূলক ও সমূলক কারণে নয়নতার ক্রমশ উত্তপ্ত হইয়া উঠিতে লাগিল। এবং অনাবশ্বক স্বত্র ধরিয়া ইন্দ্রাণীকে ‘আমাদের ম্যানেজারের স্ত্রী’ ‘আমাদের দেওয়ানের নাংনী’ বলিয়া বারম্বার পরিচিত ও অভিহিত করিতে লাগিল। তাহার একজন প্রিয় মুখরা দাসীকে শিখাইয়া দিল— সে ইন্দ্রাণীর গায়ের উপর পড়িয়া সখীভাবে তাহার গহনাগুলি হাত দিয়া নাড়িয়া নাড়িয়া সমালোচনা করিতে লাগিল ৷ কণ্ঠী এবং বাজুবন্দের প্রশংসা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ই ভাই, এ কি গিণ্টি-করা।” ইন্দ্রাণী পরম গম্ভীরমুখে কহিল, "না, এ পিতলের ।” নয়নতারা ইন্দ্রাণীকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “ওগো, তুমি ওখানে একলা দাড়িয়ে কী করছ, এই খাবারগুলো হাটখোলার পালকিতে তুলে দিয়ে এসো-না।” অদূরে বাড়ির দাসী উপস্থিত ছিল। 醇 ইন্দ্রাণী কেবল মুহূর্তকালের জন্য তাহার বিপুলপক্ষ্মীছায়াগভীর উদার দৃষ্টি মেলিয়৷ নয়নতারার মুখের দিকে চাহিল এবং পরক্ষণেই নীরবে মিষ্টান্নপূর্ণ সরাখুরি তুলিয়া লইয়া হাটখোলার পালকির উদ্দেশে নীচে চলিল । যিনি এই মিষ্টান্ন উপহার প্রাপ্ত হইয়াছেন তিনি শশব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “তুমি কেন ভাই, কষ্ট করছ, দাও-না ঐ দাসীর হাতে দাও।” ইন্দ্রাণী তাহাতে সম্মত না হইয়া কহিল, “এতে আর কষ্ট কিসের ।” অপরা কহিলেন, “তবে ভাই, আমার হাতে দাও।” ইন্দ্রাণী কহিল, "না, আমিই নিয়ে যাচ্ছি।” বলিয়া, অন্নপূর্ণ যেমন স্নিগ্ধগম্ভীর মুখে সমুচ্চ স্নেহে ভক্তকে স্বহস্তে অন্ন তুলিয়া দিতে পারিতেন তেমনি অটল স্নিগ্ধভাবে ইন্দ্রাণী পালকিতে মিষ্টান্ন রাখিয়া আসিল— এবং সেই দুই মিনিট-কালের সংস্রবে হাটখোলাবাসিনী ধনিগৃহবধু এই স্বল্পভাষিণী মিতহাসিনী ইন্দ্রাণীর সহিত জন্মের মতো প্রাণের সখীত্ব স্থাপনের জন্য উচ্ছসিত হইয়া উঠিল। এইরূপে নয়নতারা স্ত্রী জনমুলভ নিষ্ঠুর নৈপুণ্যের সহিত যতগুলি অপমানশর বর্ষণ করিল ইন্দ্রাণী তাহার কোনোটাকেই গায়ে বিধিতে দিল না ; সকলগুলিই তাহার অকলঙ্ক সমুজ্জল সহজ তেজস্বিতার কঠিন বর্মে ঠেকিয় আপনি ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। তাহার গম্ভীর অবিচলত দেখিয়া নয়নতারার আক্রোশ আরো বাড়ির উঠতে লাগিল এবং ইন্দ্রাণী তাহা বুঝিতে পারিয়া একসময় অলক্ষ্যে কাহারে নিকট বিদায় না লইয়া বাড়ি চলিয়া আসিল ।