পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२8 রবীন্দ্র-রচনাবলী উঠিল এবং স্বামীর বিশেষ আদরে ইন্দ্রাণী বাহিরের সমস্ত অনাদর বিস্তৃত হুইয় গেল । তৃতীয় পরিচ্ছেদ বিনোদবিহারী অম্বিকাচরণের উপর সম্পূর্ণ ভার দিয়া জমিদারির কাজ কিছুই দেখিতেন না । নিতান্তনির্ভর ও অতিনিশ্চয়তাবশত কোনো কোনো স্বামী ঘরের স্ত্রীকে যেরূপ অবহেলার চক্ষে দেখিয়া থাকে, নিজের জমিদারির প্রতিও বিনোদের কতকটা সেইভাবের উপেক্ষ ছিল। জমিদারির আয় এতই নিশ্চিত, এতই বাধা যে তাহাকে আয় বলিয়া বোধ হয় না, তাহা অভ্যস্ত, এবং তাহার কোনো আকর্ষণ ছিল না । বিনোদের ইচ্ছা ছিল, একটা সংক্ষেপ সুড়ঙ্গপথ অবলম্বন করিয়া হঠাৎ এক রাত্রির মধ্যে কুবেরের ভাণ্ডারের মধ্যে প্রবেশ করিবেন । সেইজন্য নানা লোকের পরামর্শে তিনি গোপনে নানাপ্রকার আজগবি ব্যবসায়ে হস্তক্ষেপ করিতেন। কখনো স্থির হইত, দেশের সমস্ত বাবলা গাছ জমা লইয়া গোরুর গাড়ির চাকা তৈরি করিবেন ; কখনো পরামর্শ হইত, সুন্দরবনের সমস্ত মধুচক্র তিনি আহরণ করিবেন ; কখনো লোক পাঠাইয়া পশ্চিমপ্রদেশের বনগুলি বন্দোবস্ত করিয়া হরীতকীর ব্যবসায় একচেটে করিবার আয়োজন হইত। বিনোদ মনে মনে ইহা বুঝিতেন যে অন্য লোকে শুনিলে হাসিবে, সেইজন্ত কণহারে কাছে প্রকাশ করিতে চাহিতেন না। বিশেষত অম্বিকাচরণকে তিনি একটু বিশেষ লজ্জা করিতেন ; অম্বিকা পাছে মনে করেন তিনি টাকাগুলো নষ্ট করিতে বসিয়াছেন, সেজন্য মনে মনে সংকুচিত ছিলেন। অম্বিকার নিকট তিনি এমনভাবে থাকিতেন যেন অম্বিকাই জমিদার এবং তিনি কেবল বসিয়া থাকিবার জন্য বার্ষিক কিছু বেতন পাইতেন। নিমন্ত্রণের পরদিন হইতে নয়নতারা তাহার স্বামীর কানে মন্ত্র দিতে লাগিলেন। “তুমি তো নিজে কিছুই দেখ না, তোমাকে অম্বিক হাত তুলিয়া যাহা দেয় তাহাই তুমি শিরোধার্য করিয়া লও ; এ দিকে ভিতরে ভিতরে কী সর্বনাশ হইতেছে তাহ কেহই জানে না। তোমার ম্যানেজারের স্ত্রী যা গয়না পরিয়া আসিয়াছিল এমন গয়না তোমার ঘরে আসিয়া আমি কখনো চক্ষেও দেখি নাই। এ-সব গয়না সে পায় কোথা হইতে এবং এত দেমাকই বা তাহার বাড়িল কিসের জোরে” ইত্যাদি ইত্যাদি । গহনার বর্ণনা নয়নতারা অনেকটা অতিরঞ্জিত করিয়া বলিল, এবং ইন্দ্রাণী নিজমুখে তাহার দাসীকে কী-সকল কথা বলিয়া গেছে তাহাও সে বহুল পরিমাণে রচনা করিয়া গেল ।