পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૨૭ রবীন্দ্র-রচনাবলী ক্রমে যখন বিনোদ বাড়াবাড়ি করিতে লাগিল, তখন অম্বিকাচরণ বিরক্ত হইয়া লোহার সিন্ধুকের চাবি নিজের কাছে রাখিলেন। বিনোদের গোপনে টাকা লওয়া একেবারে বন্ধ হইল । অথচ লোকটা এতই দুর্বল প্রকৃতি যে, প্রভু হইয়াও স্পষ্ট করিয়া এ সম্বন্ধে কোনোপ্রকার বল খাটাইতে পারিল না । অম্বিকাচরণের বৃথা চেষ্টা । অলক্ষ্মী যাহার সহায় লোহার সিন্ধুকের চাবি তাহার টাকা আটক করিয়া রাখিতে পারে না। বরং হিতে বিপরীত হইল। কিন্তু সে-সকল কথা পরে হইবে । অম্বিকাচরণের কড়া নিয়মে বিনোদ ভিতরে ভিতরে অত্যস্ত উত্ত্যক্ত হইয়াছিল। এমন সময় নয়নতারা যখন তাহার মনে সন্দেহ জন্মাইয়া দিল তখন সে কিছু খুশি হইল । গোপনে একে একে নিম্নতন কর্মচারীদিগকে ডাকিয়া সন্ধান লইতে লাগিল । তখন বামাচরণ তাহার প্রধান চর হইয়া উঠিল । গৌরীকাস্তের আমলে দেওয়ানজি বলপূর্বক পাশ্ববর্তী জমিদারের জমিতে হস্তক্ষেপ করিতে কুষ্ঠিত হইতেন না। এমন করিয়া তিনি অনেকের অনেক জমি অপহরণ করিয়াছেন। কিন্তু অম্বিকাচরণ কখনো সে কাজে প্রবৃত্ত হইতেন না। এবং মকদমা বাধিবার উপক্রম হইলে তিনি যথাসাধ্য আপসের চেষ্টা করিতেন । বামাচরণ ইহারই প্রতি প্রভুর দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। স্পষ্ট বুঝাইয়া দিল, অম্বিকাচরণ নিশ্চয় অপর পক্ষ হইতে ঘুষ লইয়া মনিবের ক্ষতি করিয়া আপল করিয়াছে। বামাচরণের নিজেরও বিশ্বাস তাহাই ; যাহার হাতে ক্ষমতা আছে সে যে ঘুষ না লইয়া থাকিতে পারে, ইহা সে মরিয়া গেলেও বিশ্বাস করিতে পারে না । এইরূপে গোপনে নানা মুখ হইতে ফুৎকার পাইয়া বিনোদের সন্দেহশিখা ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল ; কিন্তু সে প্রত্যক্ষভাবে কোনো উপায় অবলম্বন করিতেই সাহস করিল না। এক চক্ষুলজ্জা ; দ্বিতীয়ত, আশঙ্কা, পাছে সমস্ত অবস্থাভিজ্ঞ অম্বিকাচরণ তাহার কোনো অনিষ্ট করে। & অবশেষে নয়নতারা স্বামীর এই কাপুরুষতায় জলিয়া পুড়িয়া বিনোদের অজ্ঞাতসারে একদিন অম্বিকাচরণকে ডাকিয়া পর্দার আড়াল হইতে বলিলেন, “তোমাকে আর রাখা হবে না, তুমি বামাচরণকে সমস্ত হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাও।” তাহার সম্বন্ধে বিনোদের নিকট আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে সে কথা অম্বিক পূর্বেই আভাসে জানিতে পারিয়াছিলেন, সেজন্য নয়নতারার কথায় তিনি তেমন আশ্চর্য হন নাই ; তৎক্ষণাৎ বিনোদবিহারীর নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে কি আপনি কাজ থেকে নিষ্কৃতি দিতে চান।” বিনোদ শশব্যস্ত হইয়া কহিল, "না, কখনোই না।”