পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२¢० রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার মন্তক আভ্রাণ করেন। মতিলালবাবু ভাবিতে লাগিলেন, এই ছেলেটিকে যদি কোনোমতে কাছে রাধিতে পারি তবে পুত্রের অভাব পূর্ণ হয়। কেবল ক্ষুদ্র বালিকা চারুশশীর অন্ত:করণ ঈর্ষা ও বিদ্বেষে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। তৃতীয় পরিচ্ছেদ চারুশশী তাহার পিতামাতার একমাত্র সস্তান, র্তাহাদের পিতৃমাতৃস্নেহের একমাত্র অধিকারিণী। তাহার খেয়াল এবং জেদের অন্ত ছিল না। খাওয়া, কাপড় পর, চুল বাধা সম্বন্ধে তাহার নিজের স্বাধীন মত ছিল ; কিন্তু সে মতের কিছুমাত্র স্থিরতা ছিল না। যেদিন কোথাও নিমন্ত্রণ থাকিত সেদিন তাহার মায়ের ভয় হইত, পাছে মেয়েটি সাজসজ্জা সম্বন্ধে একটা অসম্ভব জেদ ধরিয়া বসে। যদি দৈবাৎ একবার চুল বাধাট তাহার মনের মতো ন হইল তবে সেদিন যতবার চুল খুলিয়া যতরকম করিয়া বাধিয়া দেওয়া যাক কিছুতেই তাহার মন পাওয়া যাইবে না, অবশেষে মহা কান্নাকাটির পালা পড়িয়া যাইবে । সকল বিষয়েই এইরূপ। আবার এক-এক সময় চিত্ত যখন প্রসন্ন থাকে তখন কিছুতেই তাহার কোনো আপত্তি থাকে না। তখন সে অতিমাত্রায় ভালোবাসা প্রকাশ করিয়া তাহার মাকে জড়াইয়া ধরিয়া, চুম্বন করিয়া, হাসিয়া বকিয়া একেবারে অস্থির করিয়া তোলে। এই ক্ষুত্র মেয়েটি একটি দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা । এই বালিকা তাহার দুর্বাধ্য হৃদয়ের সমস্ত বেগ প্রয়োগ করিয়া মনে মনে তারাপদকে স্বতীব্র বিদ্বেষে তাড়না করিতে লাগিল। পিতামাতাকেও সর্বতোভাবে উদবেজিত করিয়া তুলিল। আহারের সময় রোদনোন্মুখী হইয়া ভোজনের পাত্র ঠেলিয়া ফেলিয়া দেয়, রন্ধন তাহার রুচিকর বোধ হয় না, দাসীকে মারে, সকল বিষয়েই অকারণ অভিযোগ করিতে থাকে। তারাপদর বিদ্যাগুলি যতই তাহার এবং অন্য সকলের মনোরঞ্জন করিতে লাগিল ততই যেন তাহার রাগ বাড়িয়া উঠিল । তারাপদর যে কোনো গুণ আছে ইহা স্বীকার করিতে তাহার মন বিমুখ হইল, অথচ তাহার প্রমাণ যখন প্রবল হইতে লাগিল তাহার অসন্তোষের মাত্রাও উচ্চে উঠিল । তারাপদ যেদিন কুশলবের গান করিল সেদিন অন্নপূর্ণ মনে করিলেন, ‘সংগীতে বনের পশু বশ হয়, আজ বোধ হয় আমার মেয়ের মন গলিয়াছে।’ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “চারু, কেমন লাগল।” সে কোনো উত্তর না দিয়া অত্যন্ত প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া দিল। এই ভজিটিকে ভাষায় তর্জমা করিলে এইরূপ দাড়ায়— কিছুমাত্র ভালো লাগে নাই এবং কোনোকালে ভালো লাগিবে না । চারুর মনে ঈর্ষার উদয় হইয়াছে বুঝিরা তাহার মাতা চারুর সম্মুখে তারাপদর প্রতি