পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৫৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখিত। চারু যে সময়ে অস্তঃপুরে থাকিত সেই সময়টি বাছিয়া সোনামণি সসংকোচে তারাপদর স্বারের কাছে আসিয়া দাড়াইত। তারাপদ বই হইতে মুখ তুলিয়া সস্নেহে বলিত, “কী সোনা । খবর কী । মালি কেমন আছে ।” সোনামণি কহিত, “অনেক দিন যাও নি, মা তোমাকে একবার যেতে বলেছে । মার কোমরে ব্যথা বলে দেখতে আসতে পারে না ।” এমন সময় হয়তো হঠাৎ চারু আসিয়া উপস্থিত। সোনামণি শশব্যস্ত। সে যেন গোপনে তাহার সখীর সম্পত্তি চুরি করিতে আসিয়াছিল। চারু কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়াইয়া চোখ মুখ ঘুরাইয়া বলিত, “আঁ্যা সোনা ! তুই পড়ার সময় গোল করতে এসেছিল, আমি এখনই বাবাকে গিয়ে বলে দেব।” যেন তিনি নিজে তারাপদর একটি প্রবীণা অভিভাবিক ; তাহার পড়াশুনায় লেশমাত্র ব্যাঘাত না ঘটে রাত্রিদিন ইহার প্রতিই তাহার একমাত্র দৃষ্টি। কিন্তু সে নিজে কী অভিপ্রায়ে এই অসময়ে তারাপদর পাঠগৃহে অগসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল তাহা অন্তর্যামীর অগোচর ছিল না এবং তারাপদও তাহা ভালোরূপ জানিত। কিন্তু সোনামণি বেচারা ভীত হইয়া তৎক্ষণাং একরাশ মিথ্যা কৈফিয়ত স্বজন করিত ; অবশেষে চারু যখন ঘৃণাভরে তাহাকে মিথ্যাবাদী বলিয়া সম্ভাষণ করিত তখন সে লজ্জিত শঙ্কিত পরাজিত হইয়া ব্যথিতচিত্তে ফিরিয়া যাইত। দয়ার্দ্র তারাপদ তাহাকে ডাকিয়া বলিত, “সোনা, আজ সন্ধ্যাবেলায় আমি তোদের বাড়ি যাব এখন ।” চারু সপিণীর মতো ফোস করিয়া উঠিয়া বলিত, “যাবে বৈকি। তোমার পড়া করতে হবে না ? আমি মাস্টারমশায়কে বলে দেব না ?” চারুর এই শাসনে ভীত না হইয়া তারাপদ দুই-একদিন সন্ধ্যার পর বামুনঠাকরুনের বাড়ি গিয়াছিল। তৃতীয় বা চতুর্থ বারে চারু ফাকা শাসন না করিয়া আস্তে আস্তে এক সময় বাহির হইতে তারাপদর ঘরের দ্বারে শিকল আঁটিয়া দিয়া মার মসলার বাক্সর চাবিতালা আনিয়া তালা লাগাইয়া দিল । সমস্ত সন্ধ্যাবেলা তারাপদকে এইরূপ বন্দী অবস্থায় রাখিয়া আহারের সময় দ্বার খুলিয়া দিল। তারাপদ রাগ করিয়া কথা কহিল না এবং না খাইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল। তখন অনুতপ্ত ব্যাকুল বালিকা করজোড়ে সামুনয়ে বারম্বার বলিতে লাগিল, “তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আর আমি এমন করব না। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি খেয়ে যাও।” তাহাতেও যখন তারাপদ বশ মানিল না, তখন সে অধীর হইয়া কাদিতে লাগিল ; তারাপদ সংকটে পড়িয়া ফিরিয়া আসিয়া খাইতে বসিল । 酶 চারু কতবার একান্তমনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে যে, সে তারাপদর সহিত সদব্যবহার করিবে, আর কখনো তাহাকে মুহূর্তের জন্ত বিরক্ত করিবে না, কিন্তু সোনামণি প্রভৃতি