পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૭8 রবীন্দ্র-রচনাবলী লইয়া পড়া মুখস্থ করি। এমন-কি, সন্ধ্যার পরে ঠাকুরমার কাছে গল্প শোনাও বন্ধ করিয়া প্রদীপ জালিয়া রাত্রি দশটা এগারোটা পর্যন্ত পড়া তৈয়ারি করি। কিন্তু ছেলেবয়স ফিরিয়া পাইয়া সুবলচন্দ্র কিছুতেই স্কুলমুখে হইতে চাহেন না। স্বশীল বিরক্ত হইয়া আসিয়া বলিত, “বাবা, ইস্কুলে যাবে না?” স্থবল মাথা চুলকাইয়া মুখ নিচু করিয়া আস্তে আস্তে বলিতেন, "আজ আমার পেট কামড়াচ্ছে, আমি ইস্কুলে যেতে পারব না।” স্বশীল রাগ করিয়া বলিত, “পারবে না বইকি ! ইস্কুলে যাবার সময় আমারও আমন ঢের পেট কামড়েছে, আমি ও-সব জানি।” বাস্তবিক স্বশীল এতরকম উপায়ে স্কুল পলাইত এবং সে এত অল্পদিনের কথা যে, তাহাকে ফাকি দেওয়া তাহার বাপের কর্ম নহে। স্বশীল জোর করিয়া ক্ষুত্র বাপটিকে স্কুলে পাঠাইতে আরম্ভ করিল। স্থলের ছুটির পরে সুবল বাড়ি আসিয়া খুব একচেটি ছুটাছুটি করিয়া খেলিয়া বেড়াইবার জন্য অস্থির হইয়া পড়িতেন ; কিন্তু ঠিক সেই সময়টিতে বৃদ্ধ স্বশীলচন্দ্র চোখে চশমা দিয়া একখানা কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়া স্থর করিয়া করিয়া পড়িত, স্ববলের ছুটাছুটি গোলমালে তাহার পড়ার ব্যাঘাত হইত। তাই সে জোর করিয়া স্ববলকে ধরিয়া সম্মুখে বসাইয়া হাতে একখানা শ্লেট দিয়া অঁাক কষিতে দিত। আঁকগুলো এমনি বড়ো বড়ো বাছিয়া দিত যে, তাহার একটা কষিতেই তাহার বাপের একঘণ্টা চলিয়া যাইত। সন্ধ্যাবেলায় বুড়া সুশীলের ঘরে অনেক বুড়ায় মিলিয়া দাবা খেলিত। সে সময়টায় স্থবলকে ঠাণ্ড রাখিবার জন্য সুশীল একজন মাস্টার রাখিয়া দিল ; মাস্টার রাত্রি দশটা পর্যস্ত তাহাকে পড়াইত। খাওয়ার বিষয়ে সুশীলের বড়ো কড়াক্কড় ছিল । কারণ, তাহার বাপ স্বরল যখন বৃদ্ধ ছিলেন তখন র্তাহার খাওয়া ভালো হজম হইত না, একটু বেশি খাইলেই অম্বল হইত— কুশীলের সে কথাটা বেশ মনে আছে, সেইজন্য সে তাহার বাপকে কিছুতেই অধিক থাইতে দিত না। কিন্তু হঠাৎ অল্পবয়স হইয়া আজকাল তাহার এমনি ক্ষুধা হইয়াছে যে, মুড়ি হজম করিয়া ফেলিতে পারিতেন। সুশীল তাহাকে যতই অল্প খাইতে দিত পেটের জালায় তিনি ততই অস্থির হইয়া বেড়াইতেন। শেষকালে রোগ হইয়া শুকাইয় তাহার সর্বাঙ্গের হাড় বাহির হুইয়া পড়িল । স্বশীল ভাবিল, শক্ত ব্যামে হইয়াছে ; তাই কেবলই ঔষধ গিলাইতে লাগিল । বুড়া সুশীলেরও বড়ো গোল বাধিল। সে তাহার পূর্বকালের অভ্যাসমত যাহা করে তাহাই তাহার সহ হয় না ; পূর্বে সে পাড়ায় কোথাও যাত্রাগানের খবর পাইলেই বাড়ি হইতে পালাইয়া, ছিমে হোক, বৃষ্টিতে হোক, সেখানে গিয়া হাজির হইত। আজিকার বুড়া স্বশীল সেই কাজ করিতে গিয়া, সর্টি হইয়া, কালি হইয়া, গায়ে মাথার