পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨૭? ব্যথা হইয়া, তিন হথা শয্যাগত হইয়া পড়িয়া রহিল। চিরকাল সে পুকুরে স্নান করিয়া আসিয়াছে, আজও তাহাই করিতে গিয়া হাতের গাট পায়ের গাট ফুলিয়া বিষম বাত উপস্থিত হইল ; তাহার চিকিৎসা করিতে ছয় মাস গেল। তাহার পর হইতে দুই দিন অন্তর সে গরম জলে স্নান করিত এবং সুবলকেও কিছুতেই পুকুরে স্নান করিতে দিত না। পূর্বেকার অভ্যাসমত, ভুলিয়া তক্তপোষ হইতে সে লাফ দিয়া নামিতে যায়, আর হাড়গুলো টনটন ঝনঝন্‌ করিয়া উঠে। মুখের মধ্যে আস্ত পান পুরিয়াই হঠাৎ দেখে, দাত নাই, পান চিবানো অসাধ্য। ভুলিয়া চিরুনি ব্রুশ লইয়া মাথা আঁচড়াইতে গিয়া দেখে, প্রায় সকল মাথাতেই টাক। এক-একদিন হঠাৎ ভুলিয়া যাইত যে, সে তাহার বাপের বয়সী বুড়া হইয়াছে এবং ভুলিয়া পূর্বের অভ্যাসমত দুষ্টামি করিয়া পাড়ার বুড়ি আদি পিসির জলের কলসে হঠাৎ ঠন্‌ করিয়া ঢ়িল ছুড়িয়া মারিত— বুড়ামানুষের এই ছেলেমান্থষি দুষ্টামি দেখিয়া লোকেরা তাহাকে মার মার করিয়া তাড়াইয়া যাইত, সেও লজ্জায় মুখ রাখিবার জায়গা পাইত না। সুবলচন্দ্রও এক-একদিন দৈবাৎ ভুলিয়া যাইত যে, সে আজকাল ছেলেমানুষ হইয়াছে। আপনাকে পূর্বের মতো বুড় মনে করিয়া যেখানে বুড়ামানুষেরা তাস পাশা খেলিতেছে সেইখানে গিয়া সে বসিত এবং বুড়ার মতে কথা বলিত, শুনিয়া সকলেই তাহাকে “যা যা, খেলা করগে যা, জ্যাঠামি করতে হবে না” বলিয়া কান ধরিয়া বিদায় করিয়া দিত। হঠাৎ ভুলিয়া মাস্টারকে গিয়া বলিত, “দাও তো, তামাকটা দাও তে, খেয়ে নিই।” শুনিয়া মাস্টার তাহাকে বেঞ্চের উপর এক পায়ে দাড় করাইয়া দিত। নাপিতকে গিয়া বলিত, "ওরে বেজা, ক দিন আমাকে কামাতে আসিস নি কেন ।” নাপিত ভাবিত, ছেলেটি খুব ঠাট্টা করিতে শিখিয়াছে। সে উত্তর দিত, “আর বছরদশেক বাদে আসব এখন।” আবার এক-একদিন তাহার পূর্বের অভ্যাসমত তাহার ছেলে সুশীলকে গিয়া মারিত। সুশীল ভারি রাগ করিয়া বলিত, “পড়াশুনো করে তোমার এই বুদ্ধি হচ্ছে ? একরত্তি ছেলে হয়ে বুড়োমানুষের গায়ে হাত তোল!” অমনি চারি দিক হইতে লোকজন ছুটিয়া আসিয়া কেহ কিল, কেহ চড়, কেহ গালি দিতে আরম্ভ করে। তখন স্ববল একান্তমনে প্রার্থনা করিতে লাগিল যে, “আহা, যদি আমি আমার ছেলে স্বশীলের মতো বুড়ো হই এবং স্বাধীন হই, তাহা হইলে বাচিয়া যাই।” সুশীলও প্রতিদিন জোড়হাত করিয়া বলে, “হে দেবতা, আমার বাপের মতো অামাকে ছোটো করিয়া দাও, মনের সুখে খেলা করিয়া বেড়াই। বাবা যেরকম দুষ্টামি আরম্ভ করিয়াছেন উহাকে আর আমি সামলাইতে পারি না, সর্বদা ভাবিয়া অস্থির হইলাম।” ዄ &oob"