পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ტé&) রবীন্দ্র-রচনাবলী জীবন হয়তো নবাবের ঘরে, দরবারে কাজ করেছে। যা-কিছু সম্পদ তারা পরীতে এনেছে । সেই অর্থে টোল চলেছে, পাঠশালা বলেছে, রাস্তাঘাট হয়েছে, অতিথিশালা, যাত্র-পূজা-অৰ্চনায় গ্রামের মনপ্রাণ এক হয়ে মিলেছে। গ্রামে আমাদের দেশের প্রাণপ্রতিষ্ঠা ছিল, তার কারণ গ্রামে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সামাজিক সম্বন্ধ সেটা সত্য হতে পারে। শহরে তা সম্ভব নয়। অতএব সামাজিক মানুষ আশ্রয় পায় গ্রামে। আর, সামাজিক মাহুষের জন্তই তো সব। ধর্মকর্ম সামাজিক মানুষেরই জন্য। লক্ষপতি ক্রোড়পতি টাকার থলি নিয়ে গদিয়ান হয়ে বসে থাকতে পারে। বড়ো বড়ো হিসাবের খাতা ছাড়া তার আর কিছু নেই, তার সঙ্গে কারো সম্বন্ধ নেই। আপনার টাকার গড়খাই করে তার মধ্যে সে বসে আছে, সর্বসাধারণের সঙ্গে তার সম্বন্ধ কোথায় । এখনকার সঙ্গে তুলনা করলে অনেক অভাব আমাদের দেশে ছিল। এখন আমরা কলের জল খাই, তাতে রোগের বীজ কম ; ভালো ডাক্তার পাই, ডাক্তারখানা আছে ; জ্ঞানবিজ্ঞানের সাহায্যে অনেক সুযোগ ঘটেছে । আমি তাকে অসম্মান করি নে ; কিন্তু আমাদের খুব একটা বড়ো সম্পদ ছিল, সে হচ্ছে আত্মীয়তা। এর চেয়ে বড়ো সম্পদ নেই। এই আত্মীয়তার যেখানে অভাব সেখানে সুখশাস্তি থাকতে পারে না । সমস্ত পশ্চিম মহাদেশে মামুষে মামুষে আত্মীয়তা অত্যন্ত ভাসা-ভাসা । তার গভীর শিকড় নেই। সকলে বলছে, “আমি ভোগ করব, আমি বড়ো হব, আমার নাম হবে, আমার মুনফগ হবে।” যে তা করছে তার কতবড়ো সম্মান। তার ধনশক্তির পরিমাপ করতে গিয়ে সেখানকার লোকের মন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে । ব্যক্তিগত শক্তির এইরকম উপাসনা এমনভাবে আমাদের দেশে দেখি নি। কিছু না, একটা লোক শুধু ঘুষি চালাতে পারে। সে ঘুষির বড়ো ওস্তাদ রাস্ত দিয়ে বেরোল, রাস্তায় ভিড় জমে গেল। খবর এল সিনেমার নটী লণ্ডনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে আসছে, গাড়ির ভিতর থেকে চকিতে তাকে দেখবে বলে জনতায় রাস্তা নিরেট হয়ে উঠল। আমাদের দেশে মহদাশয় র্যাকে বলি তিনি এলে আমরা সকলে তার চরণখুলে নেব। মহাত্মা গান্ধী যদি আসেন দেশস্থদ্ধ লোক খেপে যাবে। র্তার না আছে অর্থ, না আছে বাহুবল, কিন্তু আছে হৃদয়, আছে আধ্যাত্মিক শক্তি । আমি যতদূর জানি তিনি ঘুষি মারতে জানেন না, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে তিনি বড়ো করে স্বীকার করেছেন ; আপনাকে তিনি স্বতন্ত্র করে রাখেন নি, তিনি আমাদের সকলের, আমরা সকলে তার। ব্যস, হয়ে গেল, এর চেয়ে বেশি আমরা কিছু বুঝি নে। তার চেয়ে অনেক বিদ্বান, অনেক জ্ঞানী, অনেক ধনী আছে ; কিন্তু আমাদের দেশ দেখবে আত্মদানের ঐশ্বৰ্ষ। এ কি কম কথা। এর থেকে বুৰি, আমাদের দেশের লোক কী চায় ।