পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ლ)მვ রবীন্দ্র-রচনাবলী কালে সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যের দিকে প্রসারিত। এই বোধেরই শেষ কথা এই যে, যে মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্তের আত্মাকে ও অন্তের আত্মার মধ্যে আপনার আত্মাকে জানে সেই জানে সত্যকে । মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে, একটা তার জীবভাব, আর-একটা বিশ্বভাব। জীব আছে আপন উপস্থিতকে অঁাকড়ে, জীব চলছে আশু প্রয়োজনের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে। মানুষের মধ্যে সেই জীবকে পেরিয়ে গেছে যে সত্তা সে আছে আদর্শকে নিয়ে। এই আদর্শ অন্নের মতো নয়, বস্ত্রের মতো নয়। এ আদর্শ একটা আস্তরিক আহবান, এ আদর্শ একটা নিগৃঢ় নির্দেশ। কোন দিকে নির্দেশ। যে দিকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, ষে দিকে তার পূর্ণতা, যে দিকে ব্যক্তিগত সীমাকে সে ছাড়িয়ে চলেছে, যে দিকে বিশ্বমানব। ঋগ্‌বেদে সেই বিশ্বমানবের কথা বলেছেন, পাদোহস্ত বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্তামুতং দিবি— র্তার এক চতুর্থাংশ আছে জীবজগতে, তার বাকি বৃহৎ অংশ উর্ধ্বে অমুতরূপে। মানুষ যে দিকে সেই ক্ষুদ্র অংশগত আপনার উপস্থিতকে, প্রত্যক্ষকে, অতিক্রম করে সত্য সেই দিকে সে মৃত্যুহীন ; সেই দিকে তার তপস্যা শ্রেষ্ঠকে আবিষ্কার করে। সেই দিক আছে তার অন্তরে, যেখান থেকে চিরকালের সকলের চিন্তাকে সে চিন্তিত করে, সকলের ইচ্ছাকে সে সফল করে, রূপদান করে সকলের আনন্দকে । যে পরিমাণে তার গতি এর বিপরীত দিকে, বাহিকতার দিকে, দেশকশলগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে, মানবসত্য থেকে সেই পরিমাণে সে ভ্রষ্ট ; সভ্যতার অভিমান সত্ত্বেও সেই পরিমাণে সে বর্বর । - মানবদেহে বহুকোটি জীবকোষ ; তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জন্ম, স্বতন্ত্র মরণ। অণুবীক্ষণযোগে জানা যায়, তাদের প্রত্যেকের চারি দিকে ফাক। এক দিকে এই জীবকোষগুলি আপন আপন পৃথক জীবনে জীবিত, অর-এক দিকে তাদের মধ্যে একটি গভীর নির্দেশ আছে, প্রেরণা আছে, একটি ঐক্যতত্ত্ব আছে, সেটি অগোচর পদার্থ ; সেই প্রেরণা সমগ্র দেহের দিকে, সেই ঐক্য সমস্ত দেহে ব্যাপ্ত। মনে করা । যেতে পারে, সেই সমগ্র দেহের উপলব্ধি অসংখ্য জীবকোষের অগম্য, অথচ সেই দেহের পরম রহস্যময় আহবান তাদের প্রত্যেকের কাছে দাবি করছে তাদের আত্মনিবেদন । যেখানে তারা প্রত্যেকে নিজেরই স্বতন্ত্র জীবনসীমায় বর্তমান সেখানে তার মধ্যে রহস্ত কিছুই নেই। কিন্তু, যেখানে তারা নিজের জীবনসীমাকে অতিক্রম করে সমস্ত দেহের জীবনে সত্য সেখানে তারা আশ্চর্য, সেখানে তারা আপন স্বতন্ত্র জন্মমৃত্যুর মধ্যে বন্ধ নয়। সেইখানেই তাদের সার্থকতা।