পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী "ל"לס সমুদ্র চঞ্চল হল। জোয়ার-ভাটার ওঠাপড়া চলছেই। চাদ না দেখা গেলেও সমূত্রের চাঞ্চল্যেই চাদের জাহান প্রমাণ হত। বাঁচবার চেষ্টাতেও মানুষ অনেক সময় মরে। যে ক্ষুধা তার অস্তরে নি:সংশয়, তার লক্ষ্য যে তার বাইরেও সত্য সে কথাটা সদ্যোজাত শিশুও স্বতই জানে। মানুষের প্রাণাস্তিক উদ্যম দেখা গেছে এমন কিছুর জন্যে যার সঙ্গে বাচবার প্রয়োজনের কোনো যোগই নেই । মৃত্যুকে ছাড়িয়ে আছে যে প্রাণ সেই তাকে দুঃসাহসের পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ভৌতিক প্রাণের পথে প্রাণীর নিজেকে রক্ষা ; আর এ পথে আত্মবানের আত্মীকে রক্ষা নয়, আত্মাকে প্রকাশ । বৈদিক ভাষায় ঈশ্বরকে বলেছে আবিঃ, প্রকাশস্বরূপ। তার সম্বন্ধে বলেছে, যস্ত নাম মহদ্যশ: তার মহাযশই তার নাম, তার মহং কীর্তিতেই তিনি সত্য। মানুষের স্বভাবও তাই— আত্মাকে প্রকাশ । বাইরে থেকে খাদ্যবস্তু গ্রহণ করার দ্বারাই প্রাণী আপনাকে রক্ষা করে, বাইরে আপনাকে উৎসর্গ করার দ্বারাই আত্মা আপনাকে প্রকাশ করে। এইখানে প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে গিয়ে সে আপনাকে ঘোষণা করে। এমন-কি, বর্বর দেশের মানুষও নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টায় প্রকৃতিকে লঙ্ঘন করতে চায় । সে নাক ফুড়ে মস্ত এক শলা দিয়েছে চালিয়ে। উখো দিয়ে দাত ঘষে ঘষে ছুচোলো করেছে। শিশুকালে তক্তা দিয়ে চেপে বিকৃত করেছে মাথার খুলি, বানিয়েছে বিকটাকার বেশভূষা। এই-সব উৎকট সাজে-সজ্জার অগ্রহ কষ্ট মেনেছে ; বলতে চেয়েছে, সে নিজে সহজে যা তার চেয়ে সে বড়ে । সেই তার বড়ো-আমি প্রকৃতির বিপরীত। যে দেবতাকে সে আপন আদর্শ বলে মানে সেও এমনি অদ্ভূত ; তার মহিমার প্রধান পরিচয় এই যে, সে অপ্রাকৃতিক। প্রকৃতির হাতে পালিত তৰু প্রকৃতিকে দুয়ো দেবার জন্তে মানুষের এই যেন একটা ঝগড়াটে ভাব। ভারতবর্ষেও দেখি, কত লোক, কেউ বা উর্ধ্ববাহ, কেউ বা কণ্টকশয্যায় শয়ান, কেউ বা অগ্নিকুণ্ডের দিকে নতশীর্ষ । তার জানাচ্ছে, তার শ্রেষ্ঠ, তারা সাধু, কেননা তারা অস্বাভাবিক। আধুনিক পাশ্চাত্য দেশেও কত লোক নিরর্থক কৃচ্ছসাধনের গৌরব করে। তাকে বলে রেকর্ড ব্রেক করা, দুঃসাধ্যতার পূর্ব-অধ্যবসায় পার হওয়া। সাতার কাটছে ঘন্টার পর ঘণ্টা, বাইসিকলে অবিশ্রাম ঘুরপাক খাচ্ছে, দীর্ঘ উপবাস করছে স্পর্ধা করে, কেবলমাত্র অস্বাভাবিকতার গৌরব প্রচারের জন্তে । ময়ুরকে দেখা যায় গর্ব করতে আপন ময়ুরত্ব নিয়েই, হিংস্র জন্তু উৎসাহ বোধ করে আপনার হিংস্রতার সাফল্যে। কিন্তু, বর্বর মানুষ মুখখ্রর বিরুতি ও বেশভূষার অতিকৃতি নিয়ে গর্ব করে জানায়, “আমি ঠিক মাহুষের মতে নই, সাধারণ মানুষরূপে আমাকে চেনবার জো নেই।” এমনতরো আত্মপ্রকাশের চেষ্টাকে বলি নওর্থক, এ সদর্থক নয় ; প্রকৃতির বিরুদ্ধে স্পর্ধামাত্র, যা তার সহজ তার প্রতিবাদমাত্ৰ—