পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8०९ রবীন্দ্র-রচনাবলী শক্তিও পরিমেয়। আত্মার মহিমার পরিমাণ নেই। শত্রুকে নিধনের পরিমাপ আছে, শক্ৰকে ক্ষমার পরিমাপ নেই। আত্মা যে মহার্যতায় আপন পরিচয় দেয় ও পরিচয় পায় সেই পরিচয়ের সত্য কি বিরাজ করে না অপরিমেয়ের মধ্যে, যাকে অথর্ববেদ বলেছেন সকল সীমার উদরুত্ত, সকল শেষের উৎশেষ। সে কি এমন একটি স্বয়ম্ভব বুদবুদ কোনো সমুদ্রের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই। মানুষের কাছে শুনেছি, ন পাপে প্রতিপাপঃ স্থাৎ— তোমার প্রতি পাপ যে করে তার প্রতি ফিরে পাপ কোরো না । কথাটাকে ব্যবহারে ব্যক্তিবিশেষ মানে বা নাই মানে, তবু মন তাকে পাগলের প্রলাপ বলে হেসে ওঠে না। মানুষের জীবনে এর স্বীকৃতি দৈবাৎ দেখি, প্রায় দেখি বিরুদ্ধতা, অর্থাৎ মাথা গনতি করে এর সত্য চোখে পড়ে না বললেই হয়। তবে এর সত্যতা কোনখানে। মানুষের যে স্বভাবে এটা আছে তার আশ্রয় কোথায় । মানুষ এ প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছে শুনি । যস্তাত্মা বিরত: পাপং কল্যাণে চ নিবেশিত; তেন সর্বমিদং বুদ্ধং প্রকৃতিবিকৃতিশ্চ যা। আত্মা যার পাপ থেকে বিরত ও কল্যাণে নিবিষ্ট তিনি সমস্তকে বুঝেছেন। তাই তিনি জানেন কোনটা স্বভাবসিদ্ধ, কোনটা স্বভাববিরুদ্ধ। মানুষ আপনার স্বভাবকে তখনই জানে যখন পাপ থেকে নিবৃত্ত হয়ে কল্যাণের অর্থাৎ সর্বজনের হিতসাধনা করে। অর্থাৎ মামুষের স্বভাবকে জানে মানুষের মধ্যে যারা মহাপুরুষ। জানে কী করে। তেন সর্বমিদং বুদ্ধম্। স্বচ্ছ মন নিয়ে সমস্তটাকে সে বোঝে । সত্য আছে, শিব আছে সমগ্রের মধ্যে । যে পাপ অহংসীমাবদ্ধ স্বভাবের তার থেকে বিরত হলে তবে মানুষ আপনার আত্মিক সমগ্রকে জানে, তখনই জানে আপনার প্রকৃতি । তার এই প্রকৃতি কেবল আপনাকে নিয়ে নয়, তাকেই নিয়ে যাকে গীতা বলছেন : তিনিই পৌরুষং নৃষু, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব। মানুষ এই পৌরুষের প্রতিই লক্ষ করে বলতে পারে, ধর্মযুদ্ধে মৃতো বাপি তেন লোকত্ৰয়ং জিতম্। মৃত্যুতে সেই পৌরুষকে লে প্রমাণ করে যা তার দেবত্বের লক্ষণ, যা মৃত্যুর অতীত। শ্রেয় প্রেয় নিয়ে এতক্ষণ যা বলা হল সেটা সমাজস্থিতির দিক দিয়ে নয়। নিন্দাপ্রশংসার ভিত্তিতে পাকা করে গেথে, শাসনের দ্বারা, উপদেশের দ্বারা, আত্মরক্ষার উদ্দেশে সমাজ যে ব্যবস্থা করে থাকে তাতে চিরন্তন শ্রেয়োধৰ্ম গৌণ, প্রথাঘটিত সমাজরক্ষাই মুখ্য। তাই এমন কথা শোনা যায়, শ্রেয়োধর্মকে বিশুদ্ধভাবে সমাজে প্রবর্তন করা ক্ষতিকর। প্রায়ই বলা হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভূরিপরিমাণ মুঢ়তা আছে, এইজন্তে অনিষ্ট থেকে ঠেকিয়ে রাখতে হলে মোহের দ্বারাও তাদের মন ভোলানো চাই,