পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

808 রবীন্দ্র-রচনাবলী মনের যোগফল বিশ্বমন নয়। তাই যদি হত তা হলে যা আছে তাই হত একাত্ত, যা হতে পারে তার জায়গা পাওয়া যেত না । অথচ, যা হয় নি, যা হতে পারে, মানুষের ইতিহাসে তারই জোর তারই দাবি বেশি। তারই আকাঙ্ক্ষা দুৰ্নিবার হয়ে মাহুষের সভ্যতাকে যুগে যুগে বর্তমানের সীমা পার করিয়ে দিচ্ছে। সেই আকাঙ্ক্ষা শিথিল হলেই সত্যের অভাবে সমাজ শ্ৰীহীন হয় । দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, আমার ব্যক্তিগত মনে মুখদু:খের যে অনুভূতি সেটা বিশ্বমনের মধ্যেও সত্য কি না । ভেবে দেখলে দেখা যায়, অহংসীমার মধ্যে যে মুখদুঃখ আত্মার সীমায় তার রূপান্তর ঘটে। যে মানুষ সত্যের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছে, দেশের জন্যে, লোকহিতের জন্যে— বৃহৎ ভূমিকায় যে নিজেকে দেখেছে, ব্যক্তিগত সুখদু:খের অর্থ তার কাছে উলটো হয়ে গেছে। সে মানুষ সহজেই সুখকে ত্যাগ করতে পারে এবং দুঃখকে স্বীকার করে দুঃখকে অতিক্রম করে। স্বার্থের জীবনযাত্রায় স্থখচুঃখের ভার গুরুতর, মানুষ স্বার্থকে যখন ছাড়িয়ে যায় তখন তার ভার এত হালকা হয়ে যায় যে, তখন পরম দুঃখের মধ্যে তার সহিষ্ণুতাকে, পরম অপমানের আঘাতে তার ক্ষমাকে, অলৌকিক বলে মনে হয়। আপনাকে বৃহতে উপলব্ধি করাই সত্য, অহংসীমায় অবরুদ্ধ জানাই অসত্য । ব্যক্তিগত দুঃখ এই অসত্যে । আমরা দুঃখকে যে ভাবে দেখি বৃহতের মধ্যে সে ভাব থাকতে পারে না, যদি থাকত তা হলে সেখানে দুঃখের লাঘব বা অবসান হত না। সংগীতের অসম্পূর্ণতায় বিস্তর বেম্বর আছে, সেই বেম্বরের একটিও থাকতে পারে না সম্পূর্ণ সংগীতে— সেই সম্পূর্ণ সংগীতের দিকে যতই যাওয়া যায় ততই বেস্বরের হ্রাস হতে থাকে। বেস্থর আমাদের পীড়া দেয়, যদি না দিত তা হলে স্বরের দিকে আমাদের যাত্রা এগোত না । তাই বিরাটকে বলি রুদ্র, তিনি মুক্তির দিকে আকর্ষণ করেন দুঃখের পথে। অপূর্ণতাকে ক্ষয় করার দ্বারা পূর্ণের সঙ্গে মিলন বিশুদ্ধ আনন্দময় হবে, এই অভিপ্রায় আছে বিশ্বমানবের মধ্যে । তার প্রতি প্রেমকে জাগরিত করে তারই প্রেমকে সার্থক করব, যুগে যুগে এই প্রতীক্ষার আহবান আসছে আমাদের কাছে। সেই আহবানের আকর্ষণে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে অজানার দিকে, এই যাত্রার ইতিহাসই তার ইতিহাস । তার চলার পথপাশ্বে কত সাম্রাজ্য উঠল এবং পড়ল, ধনসম্পদ হল স্তুপীকৃত, আবার গেল মিলিয়ে ধুলোর মধ্যে। তার আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেবার জন্তে কত প্রতিমা সে গড়ে তুললে, আবার ভেঙে দিয়ে গেল, বয়ল পেরিয়ে ছেলেবেলাকার খেলনার মতো ! কত মায়ামস্ত্রের চাবি বানাবার চেষ্টা করলে— তাই দিয়ে খুলতে চেয়েছিল প্রকৃতির রহস্তভাণ্ডার, আবার সমস্ত ফেলে দিয়ে নূতন করে