পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

$88. রবীন্দ্র-রচনাবলী ९ সেই সময়ে এই আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা যাকে আধ্যাত্মিক নাম দেওয়া যেতে পারে। ঠিক সেই সময়ে বা তার অব্যবহিত পরে যে ভাবে আমাকে আবিষ্ট করেছিল তার স্পষ্ট ছবি দেখা যায় আমার সেই সময়কার কবিতাতে— প্রভাতসংগীতের মধ্যে। তখন স্বতই যে ভাব আপনাকে প্রকাশ করেছে তাই ধরা পড়েছে প্রভাতসংগীতে। পরবর্তীকালে চিন্তা করে লিখলে তার উপর ততটা নির্ভর করা যেত না । গোড়াতেই বলে রাখা ভালো, প্রভাতসংগীত থেকে যে কবিতা শোনাব তা কেবল তখনকার ছবিকে স্পষ্ট দেখাবার জন্তে, কাব্যহিসাবে তার মূল্য অত্যন্ত সামান্ত । আমার কাছে এর একমাত্র মূল্য এই যে, তখনকার কালে আমার মনে যে একটা আনন্দের উচ্ছ্বাস এসেছিল তা এতে ব্যক্ত হয়েছে। তার ভাব অসংলগ্ন, ভাষা কাচা, যেন হাংড়ে হাংড়ে বলবার চেষ্টা । কিন্তু, ‘চেষ্টা’ বললেও ঠিক হবে না, বস্তুত চেষ্টা নেই তাতে, অস্ফুটবাক মন বিনা চেষ্টায় যেমন করে পারে ভাবকে ব্যক্ত করেছে, সাহিত্যের অাদর্শ থেকে বিচার করলে স্থান পাওয়ার যোগ্য সে মোটেই নয়। যে কবিতাগুলো পড়ব তা একটু কুষ্ঠিতভাবেই শোনাব, উৎসাহের সঙ্গে নয়। প্রথম দিনেই যা লিখেছি সেই কবিতাটাই আগে পড়ি। অবশু, ঠিক প্রথম দিনেরই লেখা কি না, আমার পক্ষে জোর করে বলা শক্ত | রচনার কাল সম্বন্ধে আমার উপর নির্ভর করা চলে না ; আমার কাব্যের ঐতিহাসিক যারা তারা সে কথা ভালো জানেন । হৃদয় যখন উদবেল হয়ে উঠেছিল আশ্চর্য ভাবোচ্ছাসে, এ হচ্ছে তখনকার লেখা। একে এখনকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে । আমি বলেছি, আমাদের এক দিক অহং আরএকটা দিক আত্মা। অহং যেন খণ্ডাকাশ, ঘরের মধ্যেকার আকাশ, যা নিয়ে বিষয়কর্ম মামলা-মকদ্দমা এই-সব। সেই আকাশের সঙ্গে যুক্ত মহাকাশ, তা নিয়ে বৈষয়িকতা নেই ; সেই আকাশ অসীম, বিশ্বব্যাপী । বিশ্বব্যাপী আকাশে ও খণ্ডাকাশে ষে ভেদ, অহং আর আত্মার মধ্যেও সেই ভেদ । মানবত্ব বলতে যে বিরাট পুরুষ তিনি আমার খণ্ডাকাশের মধ্যেও আছেন। আমারই মধ্যে দুটো দিক আছে— এক আমাতেই বন্ধ, আর-এক সর্বত্র ব্যাপ্ত। এই দুই’ই যুক্ত এবং এই উভয়কে মিলিয়েই আমার পরিপূর্ণ সত্তা 1 তাই বলেছি, যখন আমরা অহংকে একান্তভাবে অঁাকড়ে ধরি তখন আমরা মানবধর্ম থেকে বিচু্যত হয়ে পড়ি। সেই মহামানব, সেই বিরাটপুরুষ যিনি আমার মধ্যে রয়েছেন, তার সঙ্গে তখন ঘটে বিচ্ছেদ ।