পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রাণমন আমার জানলার সামনে রাঙা মাটির রাস্ত । ওখান দিয়ে বোঝাই নিয়ে গোরুর গাড়ি চলে ; সাঁওতাল মেয়ে খড়ের আঁটি মাথায় করে হাটে যায়, সন্ধ্যাবেলায় কলহাস্তে ঘরে ফেরে । কিন্তু, মানুষের চলাচলের পথে আজ আমার মন নেই। জীবনের ষে ভাগটা অস্থির, নানা ভাবনায় উদবিগ্ন, নানা চেষ্টায় চঞ্চল, সেটা আজ ঢাকা পড়ে গেছে। শরীর আজ রুগণ, মন আজ নিরাসক্ত । ঢেউয়ের সমুদ্র বাহিরতলের সমুদ্র ; ভিতরতলে যেখানে পৃথিবীর গভীর গর্ভশয্যা ঢেউ সেখানকার কথা গোলমাল করে ভুলিয়ে দেয় । ঢেউ যখন থামে তখন সমুদ্র আপন গোচরের সঙ্গে অগোচরের, গভীরতলের সঙ্গে উপরিতলের অথও ঐক্যে স্তব্ধ হয়ে বিরাজ করে । তেমনি আমার সচেষ্ট প্রাণ যখনি ছুটি পেল, তখনি সেই গভীর প্রাণের মধ্যে স্থান পেলুম যেখানে বিশ্বের আদিকালের লীলাক্ষেত্র। পথ-চলা পথিক যত দিন ছিলুম তত দিন পথের ধারের ঐ বটগাছটার দিকে তাকাবার সময় পাই নি ; আজ পথ ছেড়ে জানলায় এসেছি, আজ ওর সঙ্গে মোকাবিল শুরু হল । আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ক্ষণে ক্ষণে ও মেন অস্থির হয়ে ওঠে । যেন বলতে চায়, “বুঝতে পারছ না ?” আমি সাত্বনা দিয়ে বলি, “বুঝেছি, সব বুঝেছি ; তুমি আমন ব্যাকুল ছোয়ে না।” কিছু ক্ষণের জন্তে আবার শাস্ত হয়ে যায়। আবার দেখি, ভারি ব্যস্ত হয়ে ওঠে ; আবার সেই থর্থর ঝরঝর ঝলমল । আবার ওকে ঠাণ্ড করে বলি, “ই হুঁ, ঐ কথাই বটে ; আমি তোমারই খেলার সাথি, লক্ষহাজার বছর ধরে এই মাটির পেলাঘরে আমিও গণ্ডবে গণ্ডষে তোমারই মতো স্বর্যালোক পান করেছি, ধরণীর স্তন্তরসে আমিও তোমার অংশী ছিলেম।” তখন ওর ভিতর দিয়ে হঠাং হাওয়ার শব্দ শুনি ; ও বলতে থাকে, “হা, ই, ই৷ ” যে ভাষা রক্তের মর্মরে আমার হৃৎপিণ্ডে বাজে, যা আলো-অন্ধকারের নিঃশব্দ আবর্তনধ্বনি, সেই ভাষা ওর পত্রমর্মরে আমার কাছে এসে পৌঁছয় । সেই ভাষা বিশ্বজগতের সরকারি ভাষা।