পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লিপিক ১৬৫ কাগজটা পেন্সিলটা টেনে ফেলে দিলেম, রইলেম ওর দিকে অনিমেষ তাকিয়ে । ওর চিকন পাতাগুলো ওস্তাদের আঙুলের মতো আলোকৰীণায় দ্রুত তালে ঘা দিতে লাগল । হঠাৎ আমার মন বলে উঠল, “এই তুমি বা দেখছ আর এই আমি যা ভাবছি, এর মাঝখানের যোগটা কোথায় ।” আমি তাকে ধমক দিয়ে বললেম, “আবার তোমার প্রশ্ন ? চুপ করে ।” চুপ করে রইলেম, একদৃষ্টে চেয়ে দেখলেম । বেলা কেটে গেল। গাছ বললে, “কেমন, সব বুঝেছ ?” আমি বললেম, “বুঝেছি।” সেদিন তো চুপ করেই কাটল । পরদিনে আমার মন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, “কাল গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলে বুঝেছি, কী বুঝেছ বলে তো।” আমি বললেম, "নিজের মধ্যে মানুষের প্রাণটা নানা ভাবনায় ঘোলা হয়ে গেছে । তাই, প্রাণের বিশুদ্ধ রূপটি দেখতে হলে চাইতে হয় ঐ ঘাসের দিকে, ঐ গাছের দিকে ৷” "কী রকম দেখলে ।” "দেখলেম, এই প্রাণের আপনাতে আপনার কী আনন্দ । নিজেকে নিয়ে পাতায় পাতায়, ফুলে ফুলে, ফলে ফলে, কত যত্বে সে কত ছাটই ছেটেছে, কত রঙই লাগিয়েছে, কত গন্ধ, কত রস । তাই ঐ বটের দিকে তাকিয়ে নীরবে বলছিলেম,— ওগো বনস্পতি, জন্মমাত্রই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ যে আনন্দধ্বনি করে উঠেছিল সেই ধ্বনি তোমার শাখায় শাখায়। সেই আদিযুগের সরল হাসিটি তোমার পাতায় পাতায় ঝলমল করছে। অামার মধ্যে সেই প্রথম প্রাণ আজ চঞ্চল হল । ভাবনার বেড়ার মধ্যে সে বন্দী হয়ে বলে ছিল ; তুমি তাকে ডাক দিয়ে বলেছ, ওরে আয়-না রে আলোর মধ্যে, হাওয়ার মধ্যে ; আর আমারই মতো নিয়ে আয় তোর রূপের তুলি, রঙের বাটি, রসের পেয়ালা ।” মন আমার খানিক ক্ষণ চুপ করে রইল। তার পরে কিছু বিমৰ্ষ হয়ে বললে, “তুমি ঐ প্রাণের কথাটাই নিয়ে কিছু বাড়াবাড়ি ক’রে থাক, আমি যেসব উপকরণ জড়ো করছি তার কথা এমন সাজিয়ে সাজিয়ে বল না কেন ।”