পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

›ዓ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ইন্দ্র। একদিন সকলেরই সেই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রেমেই স্বৰ্গ বাচে, নইলে স্বর্গ শুকিয়ে যায়। অমৃতের অভিমানে সেই কথা তুলেছিলুম বলেই পৃথিবীতে দেবতার যাবার পথের চিহ্ন লোপ পেয়েছিল। কার্তিকেয় । দৈত্যদের পরাভবের পর থেকে আমরা আটঘাট বেঁধে স্বৰ্গকে স্বরক্ষিত করে তুলেছি। তার পর থেকে স্বর্গের ঐশ্বর্য স্বর্গের মধ্যেই জমে আসছে ; বাহিরে তার আর প্রয়োগ নেই, তার আর ক্ষয় নেই। যুগ যুগ হতে অব্যাঘাতে তার এতই উন্নতি হয়ে এসেছে যে, বাহিরের অন্ত সমস্ত-কিছু থেকে স্বৰ্গ বহু দূরে চলে গেছে। স্বর্গ তাই আজ একলা । ইন্দ্র । উন্নতিই হোক আর দুর্গতিই হোক, যাতেই চার দিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ আনে তাতেই ব্যর্থতা আনে। ক্ষুদ্র থেকে মহৎ যখন স্বদূরে চলে যায় তখন তার মহব নিরর্থক হয়ে আপনাকে আপনি ভারগ্রস্ত করে মাত্র । স্বর্গের আলো আজ আপনার মাটির প্রদীপের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলেয়ার আলো হয়ে উঠেছে, লোকলিয়ের আয়ত্তের অতীত হয়ে সে নিজেরও আয়ত্তের অতীত হয়েছে ; নির্বাপণের শাস্তির চেয়ে তার এই শাস্তি গুরুতর। দেবলোক আপনাকে অতি বিশুদ্ধ রাখতে গিয়ে আপন শুচিতার উচ্চ প্রাচীরে নিজেকে বন্দী করেছে, সেই দুর্গম প্রাচীর ভেঙে গঙ্গার ধারার মতো মলিন মর্তের মধ্যে তাকে প্রবাহিত করে দিয়ে তবে তার বন্ধনমোচন হবে । তার সেই স্বাতন্ত্র্যের বেষ্টন বিদীর্ণ করবার জন্তেই আমার মন আজ এমন বিচলিত হয়ে উঠেছে। স্বৰ্গকে আমি ঘিরতে দেব না, বৃহস্পতি ; মলিনের সঙ্গে, পতিতের সঙ্গে, অজ্ঞানীর সঙ্গে, দুঃখীর সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে হবে। বৃহস্পতি । তা হলে আপনি কী করতে চান । ইন্দ্র। আমি পৃথিবীতে যাব । বৃহস্পতি । সেই যাবার পথটাই বন্ধ, সেই নিয়েই তো ছঃখ । ইন্দ্র। দেবতার স্বরূপে সেখানে আর যেতে পারব না, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করব । নক্ষত্র যেমন খসে পড়ে তার আকাশের আলো আকাশে নিবিয়ে দিয়ে, মাটি হয়ে মাটিকে আলিঙ্গন করে, আমি তেমনি করে পৃথিবীতে যাব । বৃহস্পতি । আপনার জন্মাবার উপযুক্ত বংশ পৃথিবীতে এখন কোথায় । কার্তিকেয়। বৈগু এখন রাজা, ক্ষত্রিয় এখন বৈঙ্গের সেবার লড়াই করছে, ব্রাহ্মণ এখন বৈপ্তের দাস । ইন্দ্র। কোথায় জন্মাব সে তো আমার ইচ্ছার উপরে নেই, যেখানে আমাকে আকর্ষণ করে নেবে সেইখানেই আমার স্থান হবে।