পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় । , 89} বিরাটকে যত দিক দিয়া যত বিচিত্র করিয়া দেখিবে ততই সার্থক হইবে। তবু এ কথাও আমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, লাভের প্রতিও আমার লোভ আছে ; কেবল স্থখ নহে, এই ভ্রমণের সংকল্পের মধ্যে প্রয়োজনসাধনেরও একটা ইচ্ছা গভীরভাবে লুকানো রছিয়াছে। আমি মনে করি, যুরোপের কেহ যদি যথার্থ শ্রদ্ধা লইয়া ভারতবর্ষ ভ্রমণ করিয়া যাইতে পারেন তবে তাহারা তীর্থভ্রমণের ফললাভ করেন । তেমন যুরোপীয়ের সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছে, আমি তাহাদিগকে ভক্তি করি । সে ভক্তির কারণ ইহা নছে যে, আমাদের ভারতবর্ষের মাহাত্ম্য র্তাহাদের শ্রদ্ধার মধ্য দিয়া প্রতিফলিত হইয়া আমাদের কাছে উজ্জল হইয়া দেখা দেয় । তাছাদেরই হৃদয়ের শক্তি দেখিয়া আমার মন প্রণত হয় । অপরিচয়ের বাধা ভেদ করিয়া সত্যকে স্বীকার ও কল্যাণকে গ্রহণ করিবার ক্ষমতা সর্বদা দেখিতে পাই না । পরের দেশে না গেলে সত্যের মধ্যে সহজে সঞ্চরণ করিবার শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। যাহা অভ্যন্ত তাহাকেই বড়ো সত্য বলিয়া মানা ও যাহা অনভ্যন্ত তাহাকেই তুচ্ছ বা মিথ্যা বলিয়া বর্জন করা, ইছাই দীনাত্মার লক্ষণ । অনভ্যাসের মন্দিরের কপাট ঠেলিয়া যখন আমরা সত্যকে পূজা দিয়া আসিতে পারি, তখন সত্যের প্রতি ভক্তিকে আমরা বিশেষভাবে উপলব্ধি করিতে পারি। আমাদের সেই পূজা স্বাধীন ; আমাদের সেই ভক্তি প্রথার দ্বারা অন্ধভাবে চালিত नtए । যুরোপে গিয়া সংস্কারমুক্ত বৃষ্টিতে আমরা সত্যকে প্রত্যক্ষ করিব, এই শ্রদ্ধাটি লইয়া যদি আমরা সেখানে যাত্রা করি তবে ভারতবাসীর পক্ষে এমন তীর্থ পৃথিবীতে কোথায় মিলিবে । ভারতবর্বে আমি শ্রদ্ধাপরায়ণ যে যুরোপীয় তীর্থযাত্রীদিগকে দেখিয়াছি আমাদের দুৰ্গতি যে র্তাহাজের চোখে পড়ে নাই তাহা নহে, কিন্তু সেই ধুলায় তাহাদিগকে অন্ধ করিতে পারে নাই ; জীর্ণ আবরণের আড়ালেও ভারতবর্ষের অন্তরতম সত্যকে তাহারা দেখিয়াছেন । যুরোপেও যে সত্যের কোনো আবরণ নাই তাছা নহে। সে আবরণ জীর্ণ নহে, তাহা সমূজল। এইজন্তই সেখানকার অন্তরতম সত্যটিকে দেখিতে পাওয়া হয়তো আরও কঠিন। বীর প্রহরীদের দ্বারা রক্ষিত, মণিমুক্তার ঝালয়ের দ্বারা খচিত, সেই পর্যাটাকেই সেখানকার সকলের চেয়ে মূল্যবান পদার্থ মনে করিয়া আমরা আশ্চৰ হইয়া ফিরিয়া আলিতে পারি— তাহার পিছনে ষে দেবতা বসিয়া আছেন তাহাকে হয়তো প্ৰণাম করিয়া আসা ঘটিয়া উঠে না।