পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় - & o & সঙ্গে মিলিত করি তবে গানের বিশুদ্ধ শক্তিকে আচ্ছন্ন করিয়া দেওয়া হয় । তাই জাহাজের সেলুনে বসিয়া যখন ইহাদের গান শুনি তখন আমার কেবলই মনে হইতে থাকে, হৃদয়ের ভাবটাকে ইহারা যেন ঠেলা দিয়া, চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিতে চায়। 喇 কিন্তু, সংগীতে তো আমরা তেমন করিয়া বাহিরের দিক দিয়া দেখিতে চাই না । প্রেমিক ঠিকটি কেমন করিয়া অন্ধভব করিতেছে তাহা তো আমার জানিবার বিষয় নছে। সেই অনুভূতির অস্তরে অন্তরে যে সংগীতটি বাজিতেছে তাহাই আমরা গানে জানিতে চাই । বাহিরের প্রকাশের সঙ্গে এই অন্তরের প্রকাশ একেবারে ভিন্নজাতীয় । কারণ, বাহিরের দিকে যাহা আবেগ, অস্তরের দিকে তাহাই সৌন্দর্ব। ঈশ্বরের স্পন্দন ও আলোকের প্রকাশ যেমন স্বতন্ত্র, ইহাও তেমনি স্বতন্ত্ৰ । আমরা অশ্রীবর্ষণ করিয়া কাদি ও হাস্ত করিয়া আনন্দ প্রকাশ করি, ইহাই স্বাভাবিক। কিন্তু, দুঃখের গানে গায়ক যদি সেই অশ্রুপাতের ও মুখের গানে হাস্তধ্বনির সহায়তা গ্রহণ করে, তবে তাহাতে সংগীতের সরস্বতীর অবমাননা করা হয় সন্দেহ নাই । বস্তুত যেখানে অশ্রীর ভিতরকার অশ্রুটি ঝরিয়া পড়ে না এবং হাস্তের ভিতরকার হাস্তটি ধ্বনিয়া উঠে না, সেইখানেই সংগীতের প্রভাব । সেইখানে মাহুষের হাসিকান্নার ভিতর দিয়া এমন একটা অসীমের মধ্যে চেতনা পরিব্যাপ্ত হয় যেখানে আমাদের মুখদু:খের স্বরে সমস্ত গাছপালা নদীনিবারের বাণী ব্যক্ত হইয়া উঠে এবং আমাদের হৃদয়ের তরঙ্গকে বিশ্বহৃদয়সমূত্রেরই লীলা বুলিয়া বুঝিতে পারি। কিন্তু, স্বরে ও কণ্ঠে জোর দিয়া, ক্টোক দিয়া, হৃদয়াবেগের নকল করিতে গেলে সংগীতের সেই গভীরতাকে বাধা দেওয়া হয়। সমূত্রের জোয়ার-ভাটার মতো সংগীতের নিজের একটা ওঠানামা আছে, কিন্তু সে তাহার নিজেরই জিনিল ; কবিতার ছন্দের মতো সে তাহার সৌন্দর্ধনৃত্যের পাদবিক্ষেপ ; তাহ আমাদের হৃদয়াবেগের পুতুলনাচের খেলা নহে । অভিনয়-জিনিসটা যদিও মোটের উপর অন্তান্ত কলাবিদ্যার চেয়ে নকলের দিকে বেশি ঝোক দেয়, তবু তাছা একেবারে হরবোলার কাও নহে। তাহাও স্বাভাবিকের পর্দা ফাক করিয়া তাহার ভিতর দিকের লীলা দেখাইবার ভার লইয়াছে। স্বাভাবিকের দিকে বেশি ক্টোক দিতে গেলেই সেই ভিতরের দিকটাকে আচ্ছন্ন করিয়া দেওয়া হয়। রঙ্গমঞ্চে প্রায়ই দেখা যায়, মাছবের হৃদয়াবেগকে অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইবার জন্ত অভিনেতারা কণ্ঠস্বরে ও অঙ্গভঙ্গে জবরদস্তি প্রয়োগ করিয়া থাকে। তাহার কারণ এই যে, যে ব্যক্তি সত্যকে প্রকাশ না করিয়া সত্যকে নকল করিতে চায় লে মিথ্যা