পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫৯২ . রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘরে বলে হাপর ফোল ফোল ক'রে বাড়ির ফরমাশ খাটত সে আসছে খাতাধিখানায় কানে-পালখের-কলম-সোজা কৈলাস মুখুজের কাছে পাওনার দাবি জানাভে উঠোনে বলে টং টং আওয়াজে পুরোনো লেপের তুলে ধুনছে ধুন্থস্থি। বাইরে কানা পালোয়ানের সঙ্গে মুকুন্দলাল দারোয়ান লুটোপুটি করতে করতে কুস্তির প্যাচ কষছে। চটাচট শৰে দুই পায়ে লাগাচ্ছে চাপড়, ডন ফেলছে বিশ-পচিশ বার ঘন ঘন । ভিখিরির দল বসে আছে বরাদ্ধ ভিক্ষার আশা ক’রে । বেলা বেড়ে যায়, রোঙ্গুর ওঠে কড়া হয়ে, দেউড়িতে ঘণ্টা বেজে ওঠে ; পালকিয় ভিতরকার দিনটা ঘন্টার হিসাব মানে না। সেখানকার বারোটা সেই সাবেক কালের, . যখন রাজবাড়ির সিংহদ্বারে সভাভঙ্গের ভক্ষা বাজত, রাজা যেতেন স্বানে, চন্দনের জলে । ছুটির দিন দুপুরবেলা যাদের তীবেদারিতে ছিলুম তারা খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুম দিচ্ছে । একলা বসে আছি । চলেছে মনের মধ্যে আমার অচল পালকি, হাওয়ায় তৈরি বেছারাগুলো আমার মনের নিমক খেয়ে মানুষ । চলার পথট। কাট হয়েছে আমারই খেয়ালে। সেই পথে চলছে পালকি দূরে দূরে দেশে দেশে, সে-সব দেশের বইপড়া নাম আমারই লাগিয়ে দেওয়া। কখনো বা তার পথটা ঢুকে পড়ে ঘন বনের ভিতর দিয়ে। বাঘের চোখ জলজল করছে, গা করছে ছমছম্। সঙ্গে আছে বিশ্বনাথ শিকারী, বন্দুক ছুটল দুম, ব্যাস সব চুপ। তার পরে এক সময়ে পালকির চেহারা বদলে গিয়ে হয়ে ওঠে ময়ূরপখি, ভেসে চলে সমুত্রে, ডাঙা যায় না দেখা । দাড় পড়তে থাকে ছপছপ, ছপ ছপ, ঢেউ উঠতে থাকে দুলে স্কুলে ফুলে ফুলে। মাল্লারা বলে ওঠে, সামাল সামাল, ঝড় উঠল । হালের কাছে আবদুল মাঝি, দুচলো তার দাড়ি, গোফ তার কামানো, মাথা তার নেড়া। তাকে চিনি, সে দাদাকে এনে দিত পদ্মা থেকে ইলিশমাছ আর কচ্ছপের ডিম। লে আমার কাছে গল্প করেছিল— একদিন চক্তির মাসের শেষে ডিঙিতে মাছ ধরতে গিয়েছে, হঠাৎ এল কালবৈশাখী । ভীষণ তুফান, নৌকো ভোবে ভোবে । আবদুল দাতে রশি কামড়ে ধরে ঝাপিয়ে পড়ল জলে, সাংয়ে উঠল চরে, কাছি ধরে টেনে তুলল তার ডিঙি । গল্পটা এত শিগগির শেষ হল, আমার পছন্ম হল না। নৌকোট ডুবল না, অমনিই বেঁচে গেল, এ তো গপপই নয়। বারবার বলতে লাগলুম ‘তার পর’ ? সে বললে, “তার পর সে এক কাণ্ড । দেখি, এক নেকড়ে বাঘ। ইয়া তার গোস্কজোড়। ঝড়ের সময়ে সে উঠেছিল ও পারে গঙ্গের ঘাটের পাকুড় গাছে । দমকা হাওয়া যেমনি লাগল গাছ পড়ল ভেঙে পদ্মায়। বাঘ ভারা ভেলে ৰায় জলের তোড়ে।