পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ››ዓ বর্ষাপ্রভাতের রৌদ্রের দীপ্ত আভা তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হইল, তাহার অন্ত:করণের সম্মুখে একটা জ্যোতির্ময় যবনিকার মতো পড়িয়া প্রতিদিনের জীবনের সমস্ত তুচ্ছতাকে একেবারে আড়াল করিয়া দিল । বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল নিজের পরিপূর্ণতাকে আশ্চর্যরূপে প্রকাশ করিয়া দেয়, কিন্তু তাহার কোনো উপায় না পাইয় তাহার চিত্ত পীড়িত হইতে লাগিল । অত্যস্ত সামান্য লোকের মতোই সে আপনার পরিচয় দিয়াছে— তাহার বাসাটা অত্যন্ত তুচ্ছ, জিনিসপত্র নিতাস্ত এলোমেলো, বিছানাটা পরিষ্কার নয়, কোনো-কোনো দিন তাহার ঘরে সে ফুলের তোড়া সাজাইয়া রাখে, কিন্তু এমনি দুর্ভাগ্য— সেদিন তাহার ঘরে একটা ফুলের পাপড়িও ছিল না। সকলেই বলে বিনয় সভ্যস্থলে মুখে মুখে যেরূপ স্বন্দর বক্তৃতা করিতে পারে কালে সে এক জন মস্ত বক্ত হইয়। উঠিবে, কিন্তু সেদিন সে এমন একটা কথাও বলে নাই যাহাতে তাহার বুদ্ধির কিছুমাত্র প্রমাণ হয় । তাহার কেবলই মনে চষ্টতে লাগিল, “যদি এমন চফ্টতে পারিত যে সেই বড়ো গাড়িটা যখন তাহীদের গাড়ির উপর অসিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছে আমি বিদু্যদবেগে রাস্তার মাঝখানে আসিয়া অতি অন মাসে সেই উদশম জুড়ি ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া থামাইয়া দিতাম ? নিজের সেই কাল্পনিক বিক্রমের ছবি যখন তাহার মনের মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠিল তখন এক বার আয়নায় নিজের চেহারা না দেখিয়া থাকিতে পারিল না । এমন সময় দেখিল একটি সাত-আট বছরের ছেলে রাস্তায় দাড়াইয় তাহার বাড়ির নম্বর দেখিতেছে । বিনয় উপর হইতে বলিল, “এই-ষে, এই বাড়িষ্ট বটে ।” ছেলেটি যে তাহারই বাড়ির নম্বর খুজিতেছিল সে সম্বন্ধে তাহার মনে সন্দেহমাত্র হয় নাই । তাড়াতাড়ি বিনয় সিড়ির উপর চটিজুতা চট্‌ চট্‌ করিতে করিতে নীচে নামিয়া গেল— অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ছেলেটিকে ঘরের মধ্যে লইয়। তাহার মুখের দিকে চাহিল । সে কহিল, "দিদি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে ।” এই বলিয়া বিনন্বভূষণের হাতে এক পত্র দিল । বিনয় চিঠিখনি লইয়া প্রথমে লেফাফার উপরটাতে দেখিল, পরিষ্কার মেয়েলি ছাদের ইংরেজি অক্ষরে তাহার নাম লেখা। ভিতরে চিঠিপত্র কিছুষ্ট নাই, কেবলই কয়েকটি টাকা আছে । ছেলেটি চলিয়া যাইবার উপ ক্রম করিতেই বিনয় তাহাকে কোনোমতেই ছাড়িয়া দিল না । তাহার গলা ধরিয়া তাহাকে দোতলার ঘরে লইয়া গেল । ছেলেটির রঙ তাহার দিদির চেয়ে কালো, কিন্তু মুখের ছাদে কতকটা সাদৃশ্ব আছে । তাহাকে দেখিয়া বিনয়ের মনে ভারি একটা স্নেহ এবং আনন্দ জন্মিল ।