পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী "לס מ বেদাস্তচর্চা করিবার জন্য বিদ্যাবাগীশকে কৃষ্ণদয়াল নিযুক্ত করিয়াছিলেন । গোরা প্রথমেই ইহার সঙ্গে উদ্ধতভাবে লড়াই করিতে গিয়া দেখিল লড়াই চলে না । লোকটি ষে কেবল পণ্ডিত তাহা নয়, তাহার মতের ঔদার্য অতি আশ্চর্য । কেবল সংস্কৃত পড়িষা এমন তীক্ষ অথচ প্রশস্ত বুদ্ধি যে হইতে পারে গোরা তাহা কল্পনাও করিতে পারিত না । বিদ্যাবাগীশের চরিত্রে ক্ষমা ও শাস্তিতে পূর্ণ এমন একটি অবিচলিত ধৈর্য ও গভীরতা ছিল যে তাহার কাছে নিজেকে সংযত না করা গোরার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল। হরচন্দ্রের কাছে গোর বেদান্তদর্শন পড়িতে আরম্ভ করিল। গোরা কোনো কাজ আধা-আধি-রকম করিতে পারে না, সুতরাং দর্শন-আলোচনার মধ্যে সে একেবারে তলাইয়া গেল । ঘটনাক্রমে এই সময়ে একজন ইংরেজ মিশনারি কোনো সংবাদপত্রে হিন্দু শাস্ত্র ও সমাজকে আক্রমণ করিয়া দেশের লোককে তর্কযুদ্ধে আহবান করিলেন । গেরি তো একেবারে আগুন হইয়া উঠিল । যদিচ সে নিজে অবকাশ পাইলেই শাস্ত্র ও লোকাচারের নিন্দ করিয়া বিরুদ্ধমতের লোককে যত রকম করিয়া পারে পীড়া দিত, তবু হিন্দুসমাজের প্রতি বিদেশী লোকের অবজ্ঞা তাহাকে যেন অঙ্কুশে আহত করিয়া তুলিল । সংবাদপত্রে গোর লড়াই শুরু করিল । অপর পক্ষে হিন্দুসমাজকে যতগুলি দোষ দিয়াছিল গোরা তাহার একটা ও এবং একটুও স্বীকার করিল না । দুই পক্ষে অনেক উত্তর চালাচালি হইলে পর সম্পাদক বলিলেন, “আমরা আর বেশি চিঠিপত্র ছাপিব না ।” কিন্তু গোরার তখন রোথ চড়িয়া গেছে । সে হি তুরিজম নাম দিয়া ইংরেজিতে এক বই লিপিতে লাগিল— তাহতে তাছার সাধ্যমত সমস্ত যুক্তি ও শাসু ঘাটিয়া হিন্দুধর্ম ও সমাজের অনিন্দনীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ সংগ্ৰহ করিতে বসিয়া গেল । এমনি করিয়া মিশনারির সঙ্গে ঝগড়া করিতে গিয়া গোর আস্তে আস্তে নিজের ওকালতির কাছে নিজে হার মনিল । গোরা বলিল, “আমার আপন দেশকে বিদেশীর আদালতে আসামির মতে গাড়া করিয়া বিদেশীর আইনমতে তাহার বিচার করিতে আমরা দিবই না। বিলাতের আদর্শের সঙ্গে গুটিয়া খুটিয়া মিল করিয়া আমরা লজ্জা ও পাইব না, গৌরব ও বোধ করিব না । যে দেশে জন্মিয়াছি সে দেশের আচার, বিশ্বাস, শাস্ত্র ও সমাজের জন্য পরের ও নিজের কাছে কিছুমাত্র সংকুচিত হইয়া থাকিব না । দেশের যাহা-কিছু অাছে তাহার সমস্তই সবলে ও সগর্বে মাথায় করিয়া লইয়া দেশকে ও নিজেকে অপমান হইতে রক্ষা করিব।”