পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৯২ রবীন্দ্র-রচনাবলী মনে করতুম সাতার দেওয়া খুব সহজ— কিন্তু আজ জলের মধ্যে পড়ে এক মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি, এ তো ফাকি নয়।” এই বলিয়া বিনয় তাহার জীবনের এই আশ্চর্য আবির্ভাবকে একান্ত চেষ্টায় গোরার সম্মুখে উদঘাটিত করিতে লাগিল । বিনয় বলিতে লাগিল, আজকাল তাহার কাছে সমস্ত দিন ও রাত্রির মধ্যে কোথাও যেন কিছু ফাক নাই— সমস্ত আকাশের মধ্যে কোথাও যেন কোনো রন্ধ নাই, সমস্ত একেবারে নিবিড়ভাবে ভরিয়া গেছে—বসন্তকালের মউচাক যেমন মধুতে ভরিয়া ফাটিয়া যাইতে চায়, তেমনিতরো । আগে এই বিশ্বচরাচরের অনেকখানি তাহার জীবনের বাহিরে পড়িয়া থাকিত— যেটুকুতে তাহার প্রয়োজন সেইটুকুতেই তাহার দৃষ্টি বন্ধ ছিল। আজ সমস্তই তাহার সম্মুখে আসিতেছে, সমস্তই তাহাকে স্পর্শ করিতেছে, সমস্তই একটা নূতন অর্থে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সে জানিত না পৃথিবীকে সে এত ভালোবাসে, আকাশ এমন আশ্চর্য, আলোক এমন অপূর্ব, রাস্তার অপরিচিত পথিকের প্রবাহও এমন গভীরভাবে সত্য । তাহার ইচ্ছ। করে সকলের জন্য সে একটা কিছু করে, তাহার সমস্ত শক্তিকে আকাশের স্বর্যের মতো সে জগতের চিরন্তন সামগ্ৰী করিয়া তোলে। বিনয় যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গে এই সমস্ত কথা বলিতেছে তাহা হঠাৎ মনে হয় না। সে যেন কাহারও নাম মুখে আনিতে পারে না— আভাস দিতে গেলেও কুষ্ঠিত হইয় পড়ে। এই-যে আলোচনা করিতেছে ইহার জন্য সে যেন কাহার প্রতি অপরাধ অনুভব করিতেছে । ইহ। অন্যায়, ইহা অপমান— কিন্তু আজ এই নির্জন রাত্রে নিস্তব্ধ আকাশে বন্ধুর পাশে বসিয়া এ অন্যায়টুকু সে কোনোমতেই কাটাইতে পারিল না । সে কী মুখ ! প্রাণের আভা তাহার কপোলের কোমলতার মধ্যে কী স্বকুমার ভাবে প্রকাশ পাইতেছে! হাসিতে তাহার অন্ত:করণ কী আশ্চর্য আলোর মতো ফুটিয়া পড়ে! ললাটে কী বুদ্ধি ! এবং ঘন পল্লবের ছায়াতলে দুই চক্ষুর মধ্যে কী নিবিড় অনির্বচনীয়তা! আর সেই দুটি হাত— সেবা এবং স্নেহকে সৌন্দর্যে সার্থক করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে, সে যেন কথা কহিতেছে। বিনয় নিজের জীবনকে যৌবনকে ধন্ত জ্ঞান করিতেছে, এই আনন্মে তাহার বুকের মধ্যে যেন ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই যাহা না দেখিয়াই জীবন সাঙ্গ করে— বিনয় যে তাহাকে এমন করিয়া চোখের সামনে মূর্তিমান দেখিতে পাইবে ইহার চেয়ে আশ্চর্য কিছুই নাই ।