পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

So o o রবীন্দ্র-রচনাবলী এই অবস্থাতেই যদি বিবাহ হইয়। যাইত তবে অস্তত কন্যাপক্ষের সকলেই এই বিবাহকে বিশেষ একটা সৌভাগ্য বলিয়াই জ্ঞান করিত। কিন্তু হারানবাবু নিজের উংস্থঃ মহং জীবনের দায়িত্বকে এতই বড়ো করিয়া দেখিতেন যে কেবলমাত্র ভালো লাগার দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া বিবাহ করাকে তিনি নিজের অযোগ্য বলিয়া জ্ঞান করিলেন । এই বিবাহ-দ্বারা ব্রাহ্মসমাজ কী পরিমাণে লাভবান হইবে তাহ সম্পূর্ণ বিচার না করিয়া তিনি এ কাজে প্রবৃত্ত হইতে পারিলেন না। এই কারণে তিনি সেই দিক হইতে সুচরিতাকে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন । এরূপ ভাবে পরীক্ষা করিতে গেলে পরীক্ষা দিতেও হয় । হারানবাবু পরেশবাবুর ঘরে স্বপরিচিত হইয়া উঠিলেন। তাছাকে তাহার বাড়ির লোকে যে পাতুবাবু বলিয়া ডাকিত, এ পরিবারেও র্তাহার সেই পাম্ববাবু নাম প্রচার হইল । এখন তাহাকে কেবলমাত্র ইংরেজি বিদ্যার ভাণ্ডার, তত্ত্বজ্ঞানের আধার ও ব্রাহ্মসমাজের মঙ্গলের অবতাররূপে দেখা সম্ভবপর হইল না— তিনি যে মাতুষ, এই পরিচয়টাই সকলের চেয়ে নিকট হইয়া উঠিল । তখন তিনি কেবলমাত্র শ্রদ্ধা ও সম্বুমের অধিকারী ন হইয় ভালোলাগা মন্দলাগার আয়ত্তাধীন হইয়া আসিলেন । আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হারানবাবুর যে ভাবটা পূর্বে দূর হইতে সুচরিতার ভক্তি আকর্ষণ করিয়াছিল সেই ভাবটাই নিকটে আসিয়া তাঙ্গাকে আঘাত করিতে লাগিল । ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে যাহা কিছু সত্য মঙ্গল ও সুন্দর আছে হরিনবাবু তাতার অভিভাবকস্বরূপ হইয়া তাহার রক্ষকতার ভার লওয়াতে তাহাকে অত্যন্ত অসংগতৰূপে ছোটো দেখিতে হইল । সত্যের সঙ্গে মানুষের যথার্থ সম্বন্ধ ভক্তির সম্বন্ধ– তাহাতে মানুষকে স্বভাবতই বিনয়ী করিয়া তোলে। তাহ না করিয়া মেথানে মানুষকে উদ্ধত ও অহংকৃত করে সেখানে মানুষ আপনার ক্ষুদ্রতাকে সেই সত্যের তুলনাতেই অত্যস্ত সুস্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করে । এইখানেই পরেশবাবুর সঙ্গে হারানের প্রভেদ স্বচরিতা মনে মনে আলোচনা না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরেশবাবু ব্রাহ্মসমাজের নিকট হইতে যাহা লাভ করিয়াছেন তাহার সম্মুথে তাহার মাথা যেন সর্বদা নত হইয়া আছে— সে সম্বন্ধে তাহার লেশমাত্ৰ প্ৰগল্‌ভতা নাই – তাহার গভীরতার মধ্যে তিনি নিজের জীবনকে তলাইয়া দিয়াছেন। পরেশবাবুর শাস্ত মুখচ্ছবি দেখিলে তিনি যে সত্যকে হৃদয়ে বহন করিতেছেন তাহারই মহৰ চোখে পড়ে। কিন্তু হারানবাবুর সেরূপ নহে— তাহার ব্রাহ্মত্ব বলিয়া একটা উগ্র আত্মপ্রকাশ অন্য সমস্ত আচ্ছন্ন করিয়৷ তাহার সমস্ত কথায় ও কাজে অশোভনক্লপে বাহির হইয়া থাকে। ইহাতে সম্প্রদায়ের কাছে তাহার আদর বাড়িয়াছিল ; কিন্তু স্বচরিতা পরেশের শিক্ষাগুণে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার মধ্যে