পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ২০৩ বরদাসুন্দরী । কী জানি বাছা! তার মনে হয়েছে যে, তুমি পাল্লুবাবুকে পছন্দ কর না। ব্রাহ্মসমাজের সকল লোকেই জানে পামুবাবুর সঙ্গে তোমার বিবাহ এক রকম স্থির— এ অবস্থায় যদি তুমি— স্বচরিতা । কই, মা, আমি তো এ সম্বন্ধে কোনো কথাই কাউকে বলি নি । স্বচরিতার আশ্চর্য হইবার কারণ ছিল । সে হারানবাবুর ব্যবহারে বারবার বিরক্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু বিবাহপ্রস্তাবের বিরুদ্ধে সে কোনো দিন মনেও কোনো চিস্ত করে নাই । এই বিবাহে সে স্বর্থী হইবে কি না-হুইবে সে তর্কও তাহার মনে কোনো দিন উদিত হয় নাই, কারণ, এ বিবাহ ষে সুখদুঃখের দিক দিয়া বিচার্য নহে ইহাই সে জানিত । তখন তাহার মনে পড়িল সেদিন পরেশবাবুর সামনেই পাতুবাবুর প্রতি সে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করিয়ছিল। ইহাতেই তিনি উদবিগ্ন হইয়াছেন মনে করিয়া তাহার হৃদয়ে আঘাত লাগিল। এমন অসংযম তো সে পূর্বে কোনোদিন প্রকাশ করে নাই, পরেও কখনো করিবে না বলিয়া মনে মনে সংকল্প করিল। এ দিকে হারানবাবুও সেইদিনই অনতিকাল পরেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহার মনও চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল । এতদিন তাহার বিশ্বাস ছিল যে স্বচরিতা তাহাকে মনে মনে পূজা করে ; এই পূজার অর্ঘ্য তাহার ভাগে আরও সম্পূর্ণতর হইত যদি বৃদ্ধ পরেশবাবুর প্রতি স্বচরিতার অন্ধসংস্কারবশত একটি অসংগত ভক্তি না থাকিত। পরেশবাবু জীবনে নানা অসম্পূর্ণতা দেখাইয়া দিলেও তাহাকে স্বচরিতা যেন দেবতা বলিয়াই জ্ঞান করিত । ইহাতে হারানবাবু মনে মনে হান্তও করিয়াছেন, ক্ষুণ্ণও হইয়াছেন, তথাপি তাহার আশা ছিল কালক্রমে উপযুক্ত অবসরে এই অযথা ভক্তিকে যথাপথে একাগ্ৰধারায় প্রবাহিত করিতে পারিবেন। যাহা হউক, হারানবাবু যতদিন নিজেকে স্বচরিতার ভক্তির পাত্র বলিয়া জ্ঞান করিতেন ততদিন তাহার ছোটোখাটো কাজ ও আচরণ লইয়া কেবল সমালোচনা করিয়াছেন এবং তাহাকে সর্বদা উপদেশ দিয়া গড়িয়া তুলিতেই প্রবৃত্ত ছিলেন– বিবাহ সম্বন্ধে কোনো কথা স্পষ্ট করিয়৷ উত্থাপন করেন নাই । সেদিন স্বচরিতার দুই-একটি কথা শুনিয়া যখন হঠাং তিনি বুঝিতে পারিলেন সেও তাহাকে বিচার করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন হইতে অবিচলিত গাম্ভীর্য ও স্থৈর্য রক্ষা করা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। ইতিমধ্যে যে দুই-একবার স্বচরিতার সঙ্গে তাহার দেখা হইয়াছে পূর্বের ন্যায় নিজের গৌরব তিনি অনুভব ও প্রকাশ করিতে পারেন নাই। স্বচরিতার সঙ্গে তাহার কথায় ও আচরণে একটা কলহের ভাব দেখা দিয়াছে । তাহাকে লইয়া