পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা • २०१ আরম্ভে গোরাকে খবর দিবার জন্য নন্দ এক বার অনুরোধ করিয়াছিল— কিন্তু পাছে গোরা আসিয়া ডাক্তারি মতে চিকিৎসা করিবার জন্য জেদ করে এই ভয়ে নন্দর মা কিছুতেই গোরাকে খবর পাঠাইতে দেয় নাই । সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় বিনয় কহিল, "কী মৃঢ়তা, আর তার কী ভয়ানক শাস্তি !” গোরা কহিল, “এই মূঢ়তাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে তুমি নিজে এর বাইরে আছ মনে করে লাস্কনা লাভ কোরো না বিনয় । এই মূঢ়তা যে কত বড়ো আর এর শাস্তি যে কতখানি তা যদি স্পষ্ট করে দেখতে পেতে, তা হলে ওই একটা আক্ষেপোক্তি মাত্র প্রকাশ করে ব্যাপারটাকে নিজের কাছ থেকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করতে না ।” মনের উত্তেজনার সঙ্গে গোরার পদক্ষেপ ক্রমশই দ্রুত হইতে লাগিল । বিনয় তাহার কথায় কোনো উত্তর না করিয়া তাহার সঙ্গে সমান পা রাখিয়া চলিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইল । গোরা বলিতে লাগিল, “সমস্ত জাত মিথ্যার কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়ে রেখেছে । দেবতা, অপদেবতা, পেচে, হাচি, বৃহস্পতিবার, ত্র্যহম্পশ— ভয় যে কত তার ঠিকানা নেই– জগতে সত্যের সঙ্গে কী রকম পৌরুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় তা এর জানবে কী করে ? আর তুমি-আমি মনে করছি যে আমরা যখন দু-পাত বিজ্ঞান পড়েছি তখন আমরা আর এদের দলে নেই । কিন্তু এ কথা নিশ্চয় জেনো চার দিকের হীনতার আকর্ষণ থেকে অল্প লোক কখনোই নিজেকে বই-পড়া বিদ্যার দ্বারা বাচিয়ে রাখতে পারে না । এরা যতদিন পর্যন্ত জগদব্যাপারের মধ্যে নিয়মের আধিপতাকে বিশ্বাস না করবে, যতদিন পর্যস্ত মিথ্যা ভয়ের স্বারা জড়িত হয়ে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষিত লোকেরাও এর প্রভাব ছাড়াতে পারবে না ।” বিনয় কছিল, “শিক্ষিত লোকেরা ছাড়াতে পারলেই বা তাতে কী ! ক’ জনই বা শিক্ষিত লোক ! শিক্ষিত লোকদের উন্নত করবার জন্যেই যে অন্ত লোকদের উন্নত হতে হবে তা নয়— বরঞ্চ অন্য লোকদের বড়ো করবার জন্যেই শিক্ষিত লোকদের শিক্ষার গৌরব ।” গোরা বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “আমি তো ঠিক ওই কথাই বলতে চাই । কিন্তু তোমরা নিজেদের ভদ্রতা ও শিক্ষার অভিমানে সাধারণের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে দিব্য নিশ্চিন্ত হতে পারো এটা আমি বারম্বার দেখেছি ব’লেই তোমাদের আমি সাবধান করে দিতে চাই যে, নীচের লোকদের নিষ্কৃতি না দিলে কখনোই তোমাদের যথার্থ নিষ্কৃতি