পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२S७ রবীন্দ্র-রচনাবলী 〉br বিনয় আনন্দময়ীর কথা কয়টি ভাবিতে ভাবিতে বাসায় গেল। আনন্দময়ীর মুখের একটি কথাও এপর্যন্ত বিনয়ের কাছে কোনোদিন উপেক্ষিত হয় নাই। সে রাত্রে তাহার মনের মধ্যে একটা ভার চাপিয়া রহিল । পরদিন সকালে উঠিয়া সে যেন একটা মুক্তির ভাব অনুভব করিল। তাহার মনে হইল গোরার বন্ধুত্বকে সে একটা খুব বড়ো দাম দিয়া চুকাইয়া দিয়াছে। এক দিকে শশিমুর্থীকে বিবাহ করিতে রাজি হইয়া সে জীবনব্যাপী যে-একটা বন্ধন স্বীকার করিয়াছে ইহার পরিবর্তে আর-এক দিকে তাহার বন্ধন আলগা দিবার অধিকার হইয়াছে। বিনয় সমাজ ছাড়িয়া ব্রাহ্মপরিবারে বিবাহ করিবার জন্ত লুব্ধ হইয়াছে, গোরা তাহার প্রতি এই-যে অত্যন্ত অন্যায় সন্দেহ করিয়ছিল— এই মিথ্যা সন্দেহের কাছে সে শশিমুখীর বিবাহকে চিরন্তন জামিন-স্বরূপে রাখিয়া নিজেকে খালাস করিয়া লইল । ইহার পরে বিনয় পরেশের বাড়িতে নি:সংকোচে এবং ঘন ঘন যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিল। যাহাদিগকে ভালো লাগে তাহদের ঘরের লোকের মতো হইয়া উঠা বিনয়ের পক্ষে কিছুমাত্র শক্ত নহে । সে যেই গোরার দিকের সংকোচ তাহার মন হইতে দূর করিয়া দিল অমনি দেখিতে দেখিতে অল্প কালের মধ্যেই পরেশবাবুর ঘরের সকলের কাছেই যেন বহুদিনের আত্মীয়ের মতো হইয়া উঠিল । কেবল ললিতার মনে যে কয় দিন সন্দেহ ছিল যে স্বচরিতার মন হয়তো বা বিনয়ের দিকে কিছু ঝুকিয়াছে সেই কয়দিন বিনয়ের বিরুদ্ধে তাহার মন যেন অঙ্কধারণ করিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু যখন সে স্পষ্ট বুঝিল যে স্বচরিত বিনয়ের প্রতি বিশেষভাবে পক্ষপাতী নহে তপন তাহার মনের বিদ্রোহ দূর হইয়া সে ভারি আরাম বোধ করিল এবং বিনয়বাবুকে অসামান্য ভালো লোক বলিয়া মনে করিতে তাহার কোনো বাধা রহিল না । হারানবাবুও বিনয়ের প্রতি বিমূখ হইলেন না— তিনি একটু যেন বেশি করিয়া স্বীকার করিলেন যে বিনয়ের ভদ্রতাঞ্জান আছে । গোরার যে সেটা নাই ইহাই এই স্বীকারোক্তির ইঙ্গিত । বিনয় কখনো হারানবাবুর সম্মুখে কোনো তর্কের বিষয় তুলিত না এবং স্বচরিতারও চেষ্টা ছিল যাহাতে না তোলা হয়— এই জন্য বিনয়ের দ্বারা ইতিমধ্যে চায়ের টেবিলের শাস্তিভঙ্গ হইতে পায় নাই ।