পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ২১৭ কিন্তু হারানের অনুপস্থিতিতে স্বচরিতা নিজে চেষ্টা করিয়া বিনয়কে তাহার সামাজিক মতের আলোচনায় প্রবৃত্ত করিত । গোরা এবং বিনয়ের মতো শিক্ষিত লোক কেমন করিয়া যে দেশের প্রাচীন কুসংস্কারগুলি সমর্থন করিতে পারে ইহা জানিবার কৌতুহল কিছুতেই তাহার নিবৃত্ত হইত না । গোরা ও বিনয়কে সে যদি না জানিত তবে এ-সকল মত কেহ স্বীকার করে জানিলে স্বচরিতা দ্বিতীয় কোনো কথা না শুনিয়া তাছাকে অবজ্ঞার যোগ্য বলিয়া স্থির করিত । কিন্তু গোরাকে দেখিয়া অবধি গোরাকে সে কোনোমতে মন হইতে অশ্রদ্ধা করিয়া দূর করিতে পারিতেছে না। তাই সুযোগ পাইলেই ঘুরিয়া ফিরিয়া বিনয়ের সঙ্গে সে গোরার মত ও জীবনের আলোচনা উত্থাপন করে এবং প্রতিবাদের দ্বারা সকল কথা শেষ পর্যস্ত টানিয়া বাছির করিতে থাকে । পরেশ স্বচরিতাকে সকল সম্প্রদায়ের মত শুনিতে দেওয়াই তাহার স্বশিক্ষার উপায় বলিয়া জানিতেন, এইজন্য তিনি এ-সকল তর্কে কোনোদিন শঙ্কা অসুভব বা বাধা প্রদান করেন নাই । এক দিন স্বচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, ”আচ্ছা, গৌরমোহনবাবু কি সত্যই জাতিভেদ মানেন, না ওটা দেশামুরাগের একটা বাড়াবাড়ি ?” বিনয় কহিল, "আপনি কি সিড়ির ধাপগুলোকে মানেন ? ওগুলোও তো সব বিভাগ— কোনোট উপরে কোনোটা নীচে ।” সুচরিতা । নীচে থেকে উপরে উঠতে হয় বলেই মানি— নইলে মানবার কোনো প্রয়োজন ছিল না । সমান জায়গায় সিড়িকে না মানলেও চলে । বিনয় । ঠিক বলেছেন— আমাদের সমাজ একটা সিঁড়ি— এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হচ্ছে নীচে থেকে উপরে উঠিয়ে দেওয়া, মানবজীবনের একটা পরিণামে নিয়ে যাওয়া । যদি সমাজকে সংসারকেই পরিণাম বলে জানতুম তা হলে কোনো বিভাগব্যবস্থার প্রয়োজনষ্ট ছিল না— তা হলে যুরোপীয় সমাজের মতো প্রত্যেকে অন্তের চেয়ে বেশি দখল করবার জন্তে কাড়াকড়ি মারামারি করে চলতুম ; সংসারে যে কৃতকার্য হত সেই মাথা তুলত, যার চেষ্টা নিফল হত সে একেবারেই তলিয়ে যেত । আমরা সংসারের ভিতর দিয়ে সংসারকে পার হতে চাই বলেই সংসারের কর্তব্যকে প্রবৃত্তি ও প্রতিযোগিতার উপরে প্রতিষ্ঠিত করি নি— সংসারকর্মকে ধর্ম বলে স্থির করেছি, কেননা কর্মের দ্বারা অন্ত কোনো সফলতা নয়, মুক্তি লাভ করতে হবে, সেই জন্ত এক দিকে সংসারের কাজ, অন্ত দিকে সংসার-কাজের পরিণাম, উভয় দিকে তাকিয়ে আমাদের সমাজ বর্ণভেদ অর্থাৎ বৃত্তিভেদ স্থাপন করেছেন ।