পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা २२S বিনয় কহিল, “দেখুন, সুর্যের উদয় ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিকেরা এক রকম করে ব্যাখ্যা করে, আবার সাধারণ লোকে আর-এক রকম করে ব্যাখ্যা করে । তাতে স্বর্ষের উদরের বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি করে না। তবে কিনা সত্যকে ঠিকমতো করে জানার দরুন আমাদের একটা লাভ আছে। দেশের যে-সকল সত্যকে আমরা খণ্ডিত করে বিক্ষিপ্ত করে দেখি গোরা তার সমস্তকে এক করে সংশ্লিষ্ট করে দেখতে পায়, গোরার সেই আশ্চর্য ক্ষমতা আছে– কিন্তু সেইজন্যই কি গোরার সেই দেখাকে দৃষ্টিবিভ্রম বলে মনে করবেন ? আর যারা ভেঙে চুরে দেখে তাদের দেখাটাই সত্য ?” স্বচরিতা চুপ করিয়া রছিল। বিনয় কহিল, “আমাদের দেশে সাধারণত যে-সকল লোক নিজেকে পরম হিন্দু বলে অভিমান করে আমার বন্ধু গোরাকে আপনি সে দলের লোক বলে মনে করবেন না । আপনি যদি ওর বাপ কৃষ্ণদয়ালবাবুকে দেখতেন তা হলে বাপ ও ছেলের তফাত বুঝতে পারতেন । কৃষ্ণদয়ালবাবু সর্বদাই কাপড় ছেড়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে, পাক্তিপুথি মিলিয়ে নিজেকে স্থপবিত্র করে রাখবার জন্তে অহরহ ব্যস্ত হয়ে আছেন— রান্না সম্বন্ধে খুব ভালো বামুনকেও তিনি বিশ্বাস করেন না, পাছে তার ব্রাহ্মণত্বে কোথাও কোনো ক্রটি থাকে— গোরাকে তার ঘরের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেন না— কখনো যদি কাজের খাতিরে তার স্বীর মহলে আসতে হয়, তা হলে ফিরে গিয়ে নিজেকে শোধন করে নেন ; পৃথিবীতে দিনরাত অত্যস্ত আলগোছে আছেন পাছে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে কোনো দিক থেকে নিয়মভঙ্গের কণামাত্র ধুলো তাকে স্পর্শ করে— ঘোর বাবু যেমন রোদ কাটিয়ে, ধুলো বাচিয়ে, নিজের রঙের জেল্লা, চুলের বাহার, কাপড়ের পারিপাট্য রক্ষণ করতে সর্বদা ব্যস্ত হয়ে থাকে সেই রকম। গোরা এরকমই নয়। সে হিদুয়ানির নিয়মকে অশ্রদ্ধা করে না, কিন্তু সে অমন খুঁটে খুটে চলতে পারে না— সে হিন্দুধর্মকে ভিতরের দিক থেকে এবং খুব বড়ো রকম করে দেখে, সে কোনোদিন মনেও করে না যে হিন্দুধর্মের প্রাণ নিতাস্ত শৌখিন প্রাণ– অল্প একটু ছোয়াছুয়িতেই শুকিয়ে যায়, ঠেকাঠেকিতেই মারা পড়ে ।” স্বচরিতা । কিন্তু তিনি তো খুব সাবধানে ছোয়াছুয়ি মেনে চলেন বলেই মনে झुम्न । বিনয় । তার ওই সতর্কতাটা একটা অদ্ভূত জিনিস। তাকে যদি প্রশ্ন করা যায় সে তখনই বলে, স্থা, আমি এ-সমস্তই মানি— ছুলে জাত যায়, খেলে পাপ হয়, এ-সমস্তই অভ্রান্ত সত্য । কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, এ কেবল ওর গায়ের জোরের কথা— এ-সব কথা যতই অসংগত হয় ততই ও যেন সকলকে শুনিয়ে উচ্চস্বরে বলে। পাছে বর্তমান