পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२२ রবীন্দ্র-রচনাবলী হিন্দুয়ানির সামান্ত কথাটাকেও অস্বীকার করলে অন্ত মূঢ় লোকের কাছে হিন্দুয়ানির বড়ো জিনিসেরও অসম্মান ঘটে এবং যারা হিন্দুয়ানিকে অশ্রদ্ধা করে তারা সেটাকে নিজের জিত বলে গণ্য করে, এই জন্যে গোরা নির্বিচারে সমস্তই মেনে চলতে চায়— আমার কাছেও এ সম্বন্ধে কোনো শৈথিল্য প্রকাশ করতে চায় না । পরেশবাবু কহিলেন, "ব্রাহ্মদের মধ্যেও এরকম লোক অনেক আছে। তারা হিন্দুয়ানির সমস্ত সংস্রবই নির্বিচারে পরিহার করতে চায়, পাছে বাইরের কোনো লোক ভুল করে যে তারা হিন্দুধর্মের কুপ্রথাকেও স্বীকার করে । এ-সকল লোক পৃথিবীতে বেশ সহজভাবে চলতে পারে না— এরা হয় ভান করে, নয় বাড়াবাড়ি করে ; মনে করে সত্য দুর্বল, এবং সত্যকে কেবল কৌশল করে কিম্বা জোর করে রক্ষণ করা ষেন কর্তব্যের অঙ্গ । ‘আমার উপরে সত্য নির্ভর করছে, সত্যের উপরে আমি নির্ভর করছি নে? এই রকম যাদের ধারণা তাদেরই বলে গোড়া । সত্যের জোরকে যারা বিশ্বাস করে নিজেদের জবৰ্দস্তিকে তারা সংযত রাখে । বাইরের লোকে দু-দিন দশ-দিন ভুল বুঝলে সামান্তই ক্ষতি, কিন্তু কোনো ক্ষুদ্র সংকোচে সত্যকে স্বীকার না করতে পারলে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি । আমি ঈশ্বরের কাছে সর্বদাই এই প্রার্থনা করি যে, ব্রাহ্মের সভাতেই হোক আর হিন্দুর চণ্ডীমণ্ডপেই হোক আমি যেন সত্যকে সর্বত্রই নতশিরে অতি সহজেক্ট বিনা বিদ্রোহে প্ৰণাম করতে পরি— বাক্টরের কোনো বাধা অামাকে যেন আটক করে না রাখতে পারে ।” এই বলিয়া পরেশবাবু স্তন্ধ হইয়া আপনার মনকে যেন আপনার অস্তরে ক্ষণকালের জন্য সমাধান করিলেন। পরেশবাবু মৃদুস্বরে এষ্ট-যে কয়টি কথা বলিলেন তাহা এতক্ষণের সমস্ত আলোচনার উপরে যেন একটা বড়ো স্বর আনিয়া দিল— সে সুর ষে ওই কয়টি কথার স্বর তাহা নহে, তাহা পরেশবাবুর নিজের জীবনের একটি প্রশাস্ত গভীরতার স্বর। সুচরিতার এবং ললিতার মুখে একটি আনন্দিত ভক্তির দীপ্তি আলো ফেলিয়া গেল। বিনয় চুপ করিয়া রছিল। সেও মনে মনে জানিত গোরার মধ্যে একটা প্রচণ্ড জবৰ্দস্তি আছে— সত্যের বাহকদের বাক্যে মনে ও কর্মে যে একটি সহজ ও সরল শাস্তি থাকা উচিত তাহ গোরার নাই— পরেশবাবুর কথা শুনিয়া সে কথা তাহার মনে যেন আরও স্পষ্ট করিয়া আঘাত করিল । অবশ্য, বিনয় এতদিন গোরার পক্ষে এই বলিয়া মনে মনে তর্ক করিয়াছে যে, সমাজের অবস্থা যখন টলমল, বাহিরের দেশকালের সঙ্গে যখন বিরোধ বাধিয়াছে, তখন সত্যের সৈনিকরা স্বাভাবিকতা রক্ষা করিতে পারে না— তখন সাময়িক প্রয়োজনের আকর্ষণে সত্যের মধ্যেও ভাঙচুর আসিয়া পড়ে। আজ পরেশবাবুর কথায় বিনয় ক্ষণকালের জন্ত মনে প্রশ্ন করিল যে,