পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२8 রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বচরিত কহিল, “বাবার সঙ্গে কি আর কারও তুলনা হয় ? কিন্তু যাই বল ভাই, বিনয়বাবু ভারি চমৎকার করে বলতে পারেন।” ললিতা। ওগুলো ঠিক ওঁর মনের কথা নয় বলেই অত চমৎকার করে বলেন । যদি নিজের কথা বলতেন তা হলে বেশ দিব্যি সহজ কথা হত ; মনে হত না যে ভেবে ভেবে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন । চমৎকার কথার চেয়ে সে আমার ঢের ভালো লাগে । স্বচরিত। তা, রাগ করিল কেন ভাই ? গৌরমোহনবাবুর কথাগুলো ওঁর নিজেরই কথা হয়ে গেছে । ললিতা । তা যদি হয় তো সে ভারি বিশ্ৰ— ঈশ্বর কি বুদ্ধি দিয়েছেন পরের কথা ব্যাখ্যা করবার আর মুখ দিয়েছেন পরের কথা চমৎকার করে বলবার জন্তে ? অমন চমৎকার কথায় কাজ নেই । স্বচরিতা। কিন্তু এটা তুই বুঝছিল নে কেন যে বিনয়বাবু গৌরমোহনবাবুকে ভালোবাসেন— তার সঙ্গে ওঁর মনের সত্যিকার মিল আছে । ললিত অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, "না, ন, না, সম্পূর্ণ মিল নেই । গৌরমোহনবাবুকে মেনে চলা ওঁর অভ্যাস হয়ে গেছে— সেটা দাসত্ব, সে ভালোবাস। নয়। অথচ উনি জোর করে মনে করতে চান যে তার সঙ্গে ওঁর ঠিক এক মত, সেইজন্যেই তার মতগুলিকে উনি অত চেষ্টা করে চমৎকার করে বলে নিজেকে ও অন্তকে ভোলাতে ইচ্ছা করেন । উনি কেবলই নিজের মনের সন্দেহকে বিরোধকে চাপা দিয়ে চলতে চান, পাছে গৌরমোহনবাবুকে না মানতে হয় । তাকে না মানবার সাহস ওঁর নেই। ভালোবাসা থাকলে মতের সঙ্গে না মিললেও মানা যেতে পারে— অন্ধ না হয়েও নিজেকে ছেড়ে দেওয়া যায়– ওঁর তো তা নয়— উনি গৌরমোহনবাবুকে মানছেন হয়তো ভালোবাসা থেকে, অথচ কিছুতে সেটা স্বীকার করতে পারছেন না। ওঁর কথা শুনলেই সেটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায় । আচ্ছা দিদি, তুমি বোঝ নি ? সত্যি বলে।" স্বচরিতা ললিতার মতো এ কথা এমন করিয়া ভাবেই নাই । কারণ, গোরাকে সম্পূর্ণরূপে জানিবার জন্তই তাহার কৌতুহল ব্যগ্র হইয়াছিল— বিনয়কে স্বতন্ত্র করির দেখিবার জন্য তাহার আগ্রহই ছিল না । স্বচরিতা ললিতার প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিল, "আচ্ছা, বেশ, তোর কথাই মেনে নেওয়া গেল— তা কী করতে হবে বল।” ললিতা । আমার ইচ্ছা করে ওঁর বন্ধুর বাধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওঁকে স্বাধীন করে দিতে । স্বচরিতা । চেষ্টা করে দেখ-না ভাই ।