পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ২৩৭ করিয়া স্বচরিতা গোরাকে একটা বিশেষ দলের একটা বিশেষ মতের অসামান্ত লোক বলিয়া মনে করিয়াছিল, তাহার দ্বারা দেশের একটা কোনো বিশেষ মঙ্গল-উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে এইমাত্র সে কল্পনা করিয়াছিল— আজ স্বচরিতা তাহার মুখের দিকে একমনে চাহিতে চাহিতে সমস্ত দল, সমস্ত মত, সমস্ত উদ্দেশ্য হইতে পৃথক করিয়া গোরাকে কেবল গোরা বলিয়াই যেন দেখিতে লাগিল । চাদকে সমুদ্র যেমন সমস্ত প্রয়োজন সমস্ত ব্যবহারের অতীত করিয়া দেখিয়াই অকারণে উদ্‌বেল হইয়া উঠিতে থাকে, মুচরিতার অন্ত:করণ আজ তেমনি সমস্ত ভুলিয়া, তাহার সমস্ত বুদ্ধি ও সংস্কার, তাছার সমস্ত জীবনকে অতিক্রম করিয়া যেন চতুর্দিকে উচ্ছসিত হইয়া উঠিতে লাগিল । মাতুষ কী, মানুষের আত্মা কী, সুচরিতা এই তাহ প্রথম দেখিতে পাইল এবং এই অপূর্ব অমুভূতিতে সে নিজের অস্তিত্ব একেবারে বিশ্বত হইয়া গেল । হারানবাবু স্বচরিতার এই তদগত ভাব লক্ষ্য করিয়াছিলেন । তাহাতে তাহার তর্কের যুক্তিগুলি জোর পাইতেছিল না। অবশেষে এক সময় নিতাস্ত অধীর হইয়া তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িলেন এবং স্বচরিতাকে নিতান্ত আত্মীয়ের মতো ডাকিয়া কহিলেন, “স্বচরিতা, একবার এ ঘরে এস, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে ।” স্বচরিতা একেবারে চমকিয়া উঠিল । তাহাকে কে যেন মারিল । হারানবাবুর সহিত তাহার যেরূপ সম্বন্ধ ত{হাতে তিনি যে কখনো তাহাকে এরূপ আহবান করিতে পারেন না তাহা নহে । অন্ত সময় হইলে সে কিছু মনেই করিত না ; কিন্তু আজ গোর ও বিনয়ের সম্মুখে সে নিজেকে অপমানিত বোধ করিল । বিশেষত গোরা তাহার মুখের দিকে এমন এক রকম করিয়া চাহিল যে, সে হারানবাবুকে ক্ষমা করিতে পারিল না। প্রথমটা, সে যেন কিছুই শুনিতে পায় নাই এমনিভাবে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল । হারানবাবু তখন কণ্ঠস্বরে একটু বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “শুনছ স্বচরিতা ? আমার একটা কথা আছে, একবার এ ঘরে আসতে হবে ।” স্বচরিতা উাহার মুখের দিকে না তাকাইয়াই কছিল, "এখন থাক— বাবা আস্বন, ভার পরে হবে ।" বিনয় উঠিয়া কহিল, “আমরা নাহয় যাচ্ছি।” স্বচরিতা তাড়াতাড়ি কছিল, "না বিনয়বাৰু, উঠবেন না। বাবা আপনাদের থাকতে বলেছেন । তিনি এলেন বলে ।” তাহার কণ্ঠস্বরে একটা ব্যাকুল অমুনয়ের ভাব প্রকাশ পাইল । হরিণীকে যেন ব্যাধের হাতে ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাব হইয়াছিল । “আমি আর থাকতে পারছি নে, আমি তবে চললুম” বলিয়া হারানবাৰু