পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२8b” রবীন্দ্র-রচনাবলী দরজা খুলিয়া খানিক ক্ষণ দাড়াইয়া রহিল । তাহদের গলিটা পূর্বের দিকে একটা বড়ো রাস্তায় পড়িয়াছে ; সেই বড়ো রাস্তার পূর্বপ্রাস্তে একটা ইস্কুল আছে ; সেই ইস্কুলের সংলগ্ন জমিতে একটা পুরাতন জাম গাছের মাথার উপরে পাতল। একখণ্ড সাদা কুয়াশ" ভাসিতেছিল এবং তাহার পশ্চাতে আসন্ন স্বর্যোদয়ের অরুণরেখা ঝাপসা হইয়া দেখা দিতেছিল। গোরা চুপ করিয়া অনেকক্ষণ সেই দিকে চাহিয়! থাকিতে থাকিতে সেই ক্ষীণ কুয়াশাটুকু মিশিয়া গেল, উজ্জল রৌদ্র গাছের শাখার ভিতর দিয়া যেন অনেকগুলো ঝকঝকে সঙিনের মতো বিধিয়া বাহির হইয়। আসিল এবং দেখিতে দেখিতে কলিকাতার রাস্ত জনতায় ও কোলাহলে পূর্ণ হইয়া উঠিল । এমন সময় হঠাৎ গলির মোড়ে অবিনাশের সঙ্গে আর-কয়েকটি ছাত্রকে তাহার বাড়ির দিকে আসিতে দেখিয়া গোরা তা হার এই আবেশের জালকে সেন এক প্রবল টানে ছিন্ন করিয়া ফেলিল ; সে নিজের মনকে একটা প্রচণ্ড আঘাত করিয়ু বলিল— না, এ-সব কিছু নয় ; এ কোনোমতেই চলিবে না । বলিয়া দ্রুতবেগে শেবার ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । গোরার বাড়িতে তাহার দলবল আসিয়াছে অথচ গোরা তাহার অনেক পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া নাই, এমন ঘটনা ইহার পূর্বে আর এক দিনও ঘটিতে পায় নাই। এই সামান্য ক্রটিতেই গোরাকে ভারি একটা দিককার দিল ; সে মনে মনে স্থির করিল আর সে পরেশবাবুর বাড়ি যাইবে না এবং বিনয়ের সঙ্গে ও যাহাতে কিছুদিন দেখা না হইয়া এই-সমস্ত আলোচনা বন্ধ থাকে সেইরূপ চেষ্টা করিবে । সেদিন নীচে গিয়া এই পরামর্শ হইল যে, গোরা তাহার দলের দুই-তিন জনকে সঙ্গে করিয়া পায়ে ইটিয়া গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়া ভ্রমণে বাহির হইবে ; পথের মধ্যে গৃহস্থবাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করিবে, সঙ্গে টাকাকড়ি কিছুই লইবে না। এই অপূর্ব সংকল্প মনে লইয়া গোর। হঠাৎ কিছু অতিরিক্ত পরিমাণে উৎসাহিত হইয়া উঠিল। সমস্ত বন্ধন ছেদন করিয়া এইরূপ খোলা রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িবার একটা প্রবল আনন্দ তাহাকে পাইয়া বসিল । ভিতরে ভিতরে তাহার হৃদয় যে একটা জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে, এই বাহির হইবার কল্পনাতেই সেটা যেন ছিন্ন হইয়া গেল বলিয়া তাহার মনে হইল। এই-সমস্ত ভাবের আবেশ যে মায়ামাত্র এবং কর্মই যে সত্য সেই কথাটা খুব জোরের সহিত নিজের মনের মধ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করিয়া লইয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়া লইবার জন্য ইস্কুল-ছুটির বালকের মতো গোরা তাহার একতলার বসিবার ঘর ছাড়িয়া প্রায় ছুটিয়া বাহির হইল । সেই সময় কৃষ্ণদয়াল গঙ্গাস্নান সারিয়া ঘটতে গঙ্গাজল লইয়া নামাবলী গায়ে দিয়া মনে মনে মন্ত্র জপ করিতে