পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা २७S লে কোনো প্রশ্ন করে না । অথচ দিনের পর দিন এমনিভাবে যতই যাইতে লাগিল, গোরার বিরুদ্ধে স্বচরিতার মনের একটা অভিযোগ প্রতিদিন যেন তীব্রতর হইয়া উঠিতে লাগিল । গোরা যেন আসিবে বলিয়া প্রতিশ্রত হইয়াছিল, এমনি একটা ভাব যেন সেদিন ছিল । অবশেষে স্বচরিতা যখন শুনিল গোরা নিতান্তই অকারণে কিছু দিনের জন্ত কোথায় বেড়াইতে বাহির হইয়াছে তাহার ঠিকানা নাই, তখন কথাটাকে সে একটা সামান্ত সংবাদের মতো উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিল— কিন্তু কথাটা তাহার মনে বিধিয়াই রহিল । কাজ করিতে করিতে হঠাৎ এই কথাটা মনে পড়ে— অস্তমনস্ক হইয়া আছে, হঠাৎ দেখে এষ্ট কথাটাই সে মনে মনে ভাবিতেছিল । গোরার সঙ্গে সেদিনকার আলোচনার পর তাহার এরূপ হঠাৎ অন্তর্ধান সুচরিতা একেবারেই আশা করে নাই । গোরার মতের সঙ্গে নিজের সংস্কারের এতদূর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সেদিন তাহার অন্ত:করণে বিদ্রোহের উজান হাওয়া কিছুমাত্র ছিল না ; সেদিন সে গোরার মতগুলি স্পষ্ট বুঝিতেছিল কি না বলা যায় না, কিন্তু গোরা মানুষটাকে সে যেন একরকম করিয়া বুঝিয়াছিল । গোরার মত যাহাই থাকৃ-না সে মতে যে মানুষকে ক্ষুদ্র করে নাই, অবজ্ঞার যোগ্য করে নাই, বরঞ্চ তাহার চিত্তের বলিষ্ঠতাকে যেন প্রত্যক্ষগোচর করিয়া তুলিয়াছে— ইহা সেদিন সে প্রবলভাবে অনুভব করিয়াছে । এ-সকল কথা আর কাহারও মুখে সে সহ করিতেই পারিত না, রাগ হুইত, সে লোকটাকে মূঢ় মনে করিত, তাহাকে শিক্ষা দিয়া সংশোধন করিবার জন্য মনে চেষ্টার উত্তেজনা হইত। কিন্তু সেদিন গোরার সম্বন্ধে তাহার কিছুষ্ট হইল না ; গোরার চরিত্রের সঙ্গে, বুদ্ধির তীক্ষতার সঙ্গে, অসন্দিগ্ধ বিশ্বাসের দৃঢ়তার সঙ্গে এবং মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বরের মর্মভেদী প্রবলতার সঙ্গে তাহার কথাগুলি মিলিত হইয়া একট, সজীব ও সত্য আকার ধারণ করিয়াছিল । এ-সমস্ত মত স্বচরিতা নিজে গ্রহণ না করিতে পারে, কিন্তু আর কেহ যদি ইহাকে এমনভাবে সমস্ত বুদ্ধি-বিশ্বাস সমস্ত জীবন দিয়া গ্রহণ করে তবে তাছাকে ধিক্কার দিবার কিছুই নাই, এমন-কি বিরুদ্ধ সংস্কার অতিক্রম করিয়াও তাহাকে শ্রদ্ধা করা যাইতে পারে— এই ভাবটা স্বচরিতাকে সেদিন সম্পূর্ণ অধিকার করিয়াছিল। মনের এই অবস্থাটা স্বচরিতার পক্ষে একেবারে নূতন । মতের পার্থক্য সম্বন্ধে সে অত্যন্ত অসহিষ্ণু ছিল ; পরেশবাবুর একপ্রকার নির্লিপ্ত সমাহিত শাস্ত জীবনের দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও সে সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে বাল্যকাল হইতে বেষ্টিত ছিল বলিয়া মত জিনিসটাকে অতিশয় একাস্ত করিয়া দেখিত— সেইদিনই প্রথম সে মামুষের সঙ্গে মতের সঙ্গে সম্মিলিত করিয়া দেখিয়া একটা যেন সজীব সমগ্র